সাদেক হোসেন খোকার পাসপোর্ট ও নির্বাসনের রাজনীতি
বিএনপির নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা ইন্তেকাল করেছেন। তিনি গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। এই দেশের জন্য তিনি প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একাত্তরের গেরিলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, সাদেক হোসেন খোকা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি ঢাকা শহরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের বড় সত্য এটাই। যে যাই বলুক না কেনো, এই সত্য অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, আমি, মায়া, খোকা আমরা যে কয়জন নেতৃস্থানীয় ছিলাম, তাদের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ হয়েছে। আগরতলার মেলাঘরে যোগাযোগ হয়েছে। আমরা ছিলাম ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা। খোকা ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা না হলেও ঢাকার অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খোকার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যোগাযোগ ছিল। ওই সময়ে আমাদের দেখা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আদর্শিক রাজনীতিতে আমার সঙ্গে তার দ্বিমত ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগাযোগ ছিল।
ছাত্র থাকাবস্থাতেই যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তৎকালীন এই ছাত্র নেতা কসবা-মন্দভাগ, মির্জাপুর সীমান্ত এলাকার সাব সেক্টরে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ট্রেনিং শেষে একটি গেরিলা গ্রুপের কমান্ডার হিসাবে ঢাকায় আসেন সাদেক হোসেন খোকা। ঢাকায় অনেকগুলো সফল অপারশেনের নেতৃত্ব দেন এই সাহসী গেরিলা যোদ্ধা। পরবর্তীতে রাজনীতিতে আসা এই যোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপরিসীম দরদ দেখিয়েছেন। ঢাকার মেয়র থাকার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার অনেক সড়কের নামকরণ করেছেন।
খোকা মওলানা ভাসানীর ন্যাপ থেকে পরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপির সাথে ঘনিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালালদের সাথেও রাজনীতি করতে হয়েছে তাঁকে। খোকা সম্পর্কে খুবই বাজে একটি কথা বলেছিলেন বিএনপির আরেক নেতা সালাউদদিন কাদের চৌধুরী। আমি সেই কথাটি আজকের লেখায় লিখতে চাইছি না।
আমাদের মনে আছে, ১৯৭৯ সালে জিয়া যে নির্বাচন করেছিলেন সে নির্বাচনে রাউজান থেকে জিয়া বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন এ কে খানের পুত্র জহির উদ্দিন খানকে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের। জিয়া সেই সময় রাউজান ও পাহাড়তলীতে দুটি নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে সুস্পষ্টভাবে তিনি উল্লেখ করেছেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ১৯৭১ সালের ঘৃণ্য কার্যকলাপ। প্রকারান্তরে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন দৈনিক বাংলা ও দৈনিক সংবাদের রিপোর্টগুলো দেখলেই তা জানা যাবে।
সাদেক হোসেন খোকা, নিউইয়র্কে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। তাঁর ক্যান্সার হয়েছিল। একসময় তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল ২০১৭ সালে। তিনি নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে নবায়ন/নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাঁর পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় নি। কেন হয়নি, এর উত্তর অনেকেই জানেন না। এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বিবিসি'কে বলেছেন, পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোন হস্তক্ষেপ ছিল না। তবে নবায়ন না করার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
"পাসপোর্ট দেয়া বা নবায়ন করা-এর সাথে রাজনীতির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। রাজনৈতিক দলেরও এতে কোন দায়িত্ব নেই। যারা এসব অধিদপ্তরের সাথে জড়িত, তারা ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবে। তবে পাসপোর্ট নবায়ন না করাটা দুঃখজনক এবং অনৈতিক বলে আমি মনে করি।" তাহলে কি রাষ্ট্রের কোনো কর্মচারী অতি উৎসাহী হয়ে খোকার পাসপোর্ট আটকে রেখেছিলেন? যদি তাই হয়- সেটাও রাষ্ট্রকেই খতিয়ে দেখতে হবে।
এটা খুবই দুঃখজনক, বাংলাদেশে নির্বাসনের রাজনীতি শুরু হয়েছে সামরিক জান্তাদের হাত ধরে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাঁর দুই কন্যাকে দেশে আসতে দেয়া হয়নি। এই বিষয়ে বার বার স্মৃতিচারণ করেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্য শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন- ''খুনি মোশতাক ও তার দোসর জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্টে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয়। জিয়া নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। আমি ও রেহানা দেশে ফিরতে চাইলে আমাদের বাধা দেয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আমাদের বিদেশের মাটিতেই পড়ে থাকতে হয়। খুনি জিয়া আমাকে ও আমার বোন শেখ রেহানাকে দেশে আসতে দেয়নি। সে সময় সমগ্র বাংলাদেশকেই কয়েদখানায় পরিণত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসলে জিয়াউর রহমান বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীবাহিনী সব বাধা উপেক্ষা করে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।
তিনি বলেন, দেশে এসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইলে ওই বাড়িতে যেতে দেয়া হয়নি। পিতা-মাতা, ভাইদের জন্য একটু দোয়া করার সুযোগও দেয়া হয়নি। পুলিশ পাহারা ও গেটে তালা দিয়ে আমার আসার পথ রুদ্ধ করা হয়। আমি রাস্তার ওপরই বসে পড়ি এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়ি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট শুধু যে ঘাতকরা হত্যাকান্ড করেছে তাই না, তারা বাড়িতে লুটপাটও করে। ১৯৮১ সালের ১২ জুন পর্যন্ত ওই বাড়িতে কোন মানুষকে ঢুকতে দেয়া হয়নি।''
জাতির পিতার উত্তরসূরি বলেছেন-''জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১২ জুন হঠাৎ করে এক ঘণ্টার নোটিশে বাড়িটি আমাকে তাড়াহুড়ো করে হস্তান্তর করা হয়। খুনি, ষড়যন্ত্রকারীরা জনমানুষের সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। আর আমি ও আমার বোন শেখ রেহানাও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না।''
বাংলাদেশে আজ অধিকারের কথা বলা হচ্ছে। অবশ্যই অধিকার চাই। একটি সুশীল সমাজ আজ বলে বেড়াচ্ছেন, পাসপোর্ট নাগরিক অধিকার। কিন্তু শেখ হাসিনা কি বলেছিলেন তা কি আপনাদের মনে আছে? শেখ হাসিনা বলেছিলেন-
‘জিয়াউর রহমান এই হত্যার সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত ছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে। রেহানার পাসপোর্ট আটকে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। বিকৃত ইতিহাস এদেশের মানুষকে শোনানো হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সত্যকে চাপিয়ে রাখা যায় না।’
বাংলাদেশকে এই কালো অধ্যায় থেকে উদ্ধার দরকার। খুনি সামরিক জান্তাদের শাসন এখন নেই।বাংলাদেশে এখন জাতির পিতার আদর্শের সরকার দায়িত্বে। তাই এই সরকারের কাছ থেকে ওই 'খুনি জান্তাদের আচরণ' প্রত্যাশিত নয়। রাজনৈতিক আচরণ শোভনীয়ই হতে হয়। আমি মনে করি, সাদেক হোসেন খোকা তাঁর পাসপোর্ট ফেরৎ পেতে পারতেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা, সাজা থাকলে তিনি দেশে গিয়ে তা মোকাবেলা করতে চাইলে ,করতে পারতেন। তার পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রিনিউ না করতে পারায় তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি ঘটনা লিখতে চাই। এই সময়ের সাহসী লেখক, শব্দজন লুৎফর রহমান রিটন তার একটি লেখায় সাদেক হোসেন খোকাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-
[প্রিয় খোকা ভাই,
এই প্রতিবেদন পাঠ করে একটুও ব্যথিত হইনি আমি। কারণ, নিজেদের গড়া অলিখিত ঘৃণ্য অমানবিক নিয়মেরই শিকার হয়েছেন আপনি। নাথিং এলস্! বিরুদ্ধমতের মানুষকে পাসপোর্টবিহীন নাগরিকে রূপান্তরের ইতিহাস আপনারাই রচনা করেছিলেন। ২০০১-এর নভেম্বরে আপনারা জামায়াত-বিএনপি চারদলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকে আমি দেশান্তরি ছিলাম। বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং ঘাতক-রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লেখালেখির অপরাধে অতি নগন্য আমার পাসপোর্টটি বাতিল করা হয়েছিলো। নাগরিক হিশেবে বাংলাদেশের সবুজ একটি পাসপোর্ট আমারও প্রাপ্য ছিলো। আবেদনও করেছিলাম যথারীতি, কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসে।
২০০২ থেকে টানা সাত বছর আমি অপেক্ষা করেছি। মাসের পর মাস বছরের পর বছর আমি ছুটে গেছি দূতাবাসে। কিন্তু আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রাপ্য পাসপোর্ট থেকে। গত কয়েক মাস ধরে দেশে ফেরার জন্য আপনি যেমন অনেকটা পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন, আমার অবস্থাও তো তেমনই ছিলো! আপনার মতো আমিও পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম দেশে ফেরার জন্যে। গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছি প্রবাসে নিজের ঘরে। কিন্তু আপনার সরকার আমার প্রতি সামান্য দয়াও দেখায়নি। আমি দেশে ফিরতে পারিনি। মঈন-ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অবশেষে আমি আমার কাঙ্খিত সবুজ পাসপোর্টি পেয়েছিলাম।]
বিষয়টি কি মর্মবিদারক নয়?
আবারও বলি, একজন মুক্তিযোদ্ধা এই দেশের সূর্যসন্তান। তাঁর অধিকার অবশ্যই পাওয়া উচিৎ ছিল। ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে কফিনে হয়ে দেশে ফেরা তাঁর জন্য সম্মানজনক ছিল না। তাকে দেশে ফিরে যে কোনো সাজা মোকাবেলার সুযোগ দেয়া যেতে পারতো। বাংলাদেশকে এই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানে রাখতে হবে এখন জাতির পিতার কন্যা রাষ্ট্রক্ষমতায়।
নিশ্চয়ই আমরা তাঁর কাছ থেকে আলোকিত বাংলাদেশ আশা করি।
লেখক : নিউইর্য়কপ্রবাসী কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর