সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না
বাংলাদেশে কোনো পুলিশ সুপারের বদলির খবর কখনোই জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হওয়ার মতো সংবাদ নয়। আসলে এটি কোনো সংবাদই নয়। কিন্তু একজন পুলিশ সুপারের বদলির খবর স্থানীয় পত্রিকায় শীর্ষ সংবাদ হয়েছে। আর জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্ব সহকারে। তোলপাড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। এই আলোচিত পুলিশ সুপারের নাম হারুন অর রশিদ। নারায়ণগঞ্জ থেকে তাকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে। বিষয়টা আসলে সাধারণ বদলি নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে প্রত্যাহার। হারুন অর রশিদকে পুলিশ সদরদফতরে (ট্রেনিং রিজার্ভ) সংযুক্ত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে এসপি হিসেবে যোগদানের পার থেকেই তিনি তুমুল আলোচনায় ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সংসদ সদস্য মহাপরাক্রমশালী শামীম ওসমানের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। যাকে কেউ কখনো স্পর্শ করার সাহস পায়নি, হারুন অর রশিদ দায়িত্ব নেয়ার পর সেই শামীম ওসমানের বিভিন্ন স্বার্থে আঘাত হানেন। এই চমক দিয়ে এক ধরনের জনপ্রিয়তাও পান তিনি। এর আগে গাজীপুরের এসপি থাকার সময়ও নানা কারণে আলোচিত ছিলেন হারুন অর রশিদ। এখন জানা যাচ্ছে, এই আলোচনা, এই প্রভাব তিনি চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহার করেছিলেন। চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগেই তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় আনা হয়েছে।
আমি সবসময় বলি, সবারই তার সীমাটা জানা থাকা দরকার। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না। অপরাধের পেয়ালা যখন উপচেপড়ে, তখন প্রকৃতির একটা বিচার হয়ে যায়। এটা সমাজের সবক্ষেত্রের জন্যই সত্যি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা টেন্ডারবাজি করবে, চাঁদাবাজি করবে, একটু মাস্তানি করবে; এটা সবাই জানে এবং বাধ্য হয়ে সবাই মেনেও নিয়েছে। কিন্তু সেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়; তখনই মেনে নেয়ার সীমাও ছাড়িয়ে যায়। দুই মাস আগেও ইসমাইল হোসেন সম্রাটের নামে কাঁপত ঢাকার শহর। যুবলীগের মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই যুবলীগের সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। ক্লাবে চাঁদাবাজি এককথা, আর স্পোর্টিং ক্লাবকে ক্যাসিনো ক্লাব বানিয়ে ফেলা আরেক ব্যাপার। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময়ে শত কোটি, হাজার কোটি টাকা কামিয়ে ফেলা সম্রাট, খালেদ ভূঁইয়া, জি কে শামীমদের দিন কাটে এখন রিমান্ডে আর কারাগারে। এসবই হলো সীমা লঙ্ঘনের পরিণতি।
নারায়ণগঞ্জের সদ্যসাবেক এসপি হারুন অর রশিদও সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন। তাই প্রবল প্রতাপশালী এসপি থেকে তিনি এখন ওএসডি। সবসময়ই পুলিশ হওয়ার কথা জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশ মানেই যেন আতঙ্ক। ভয়ে কেউ পুলিশের কাছে যেতে চায় না। সবাই জানে- বাঘে ছুলে আঠার ঘা, পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা। বাংলাদেশে মানুষ বেশি, তুলনামূলকভাবে পুলিশের সংখ্যা কম। তাই পুলিশ সদস্যদের অনেক বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। তাদের কোনো নির্ধারিত অফিস সময় নেই, ছুটি নেই। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। সাধারণ মানুষের নিরাপদ ঘুম নিশ্চিত করতে, বিনিদ্র থাকে পুলিশ সদস্যরা। যারা পুলিশ লাইনে থাকেন, তাদের জীবনমান দেখলে আপনারও মায়া লাগবে। মানবেতর জীবন বলতে যা বোঝায় তাই। পুলিশ সদস্যরা যা বেতন পান, তা দিয়ে মানসম্মত মধ্যবিত্ত জীবনযাপন অসম্ভব। পুলিশের বিরুদ্ধে তাই ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ খুব সাধারণ। এটাও মানুষ বাধ্য হয়ে মেনেই নিয়েছে। কিন্তু যখনই সীমা ছাড়িয়ে যায়, গোল বাধে তখনই।
সাধারণ মানুষ ভয়ে পুলিশকে এড়িয়ে চলে। কারণ পুলিশ চাইলে যখন তখন, যেকোনো মানুষকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। তার হাতে অস্ত্র আছে, তার হাতে আইন আছে। পুলিশ চাইলে নিছক সন্দেহের কারণেই যে কাউকে আটক করতে পারে। এছাড়া প্রায় সব মামলাতেই অজ্ঞাতনামা কিছু আসামি থাকে। পুলিশ চাইলে যে কাউকেই যেকোনো মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেফতার করতে পারে। তাছাড়া পুলিশের নিয়ে যাওয়া মদ, ইয়াবা, ফেনসিডিল দিয়ে কাউকে গ্রেফতার করার ঘটনাও সবাই জানেন, কিন্তু চ্যালেঞ্জ করার উপায় থাকে না কারও। রাস্তায় মোটরসাইকেল আটকে পকেটে গাঁজা বা ইয়াবা দিয়ে হয়রানির ভুক্তভোগীর সীমা নেই। পুলিশ এসবই করে সাধারণ, নিরপরাধ, নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করার জন্য।
টাকা না পেলে পুরোনো মামলা বা মাদক মামলায় চালান করে দেয়া হয় অহরহই। তাতেই বরবাদ হয়ে যায় কত মানুষের জীবন। আদালতে ঘুরতে ঘুরতে কত মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়, সে খবর কে রাখে। ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যার জন্য পুলিশ যে ডাহা মিথ্যা গল্পটি সাজায়, তাও সবার মুখস্ত- গ্রেফতার আসামিকে নিয়ে গভীর রাতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে অতর্কিতে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। পুলিশও পাল্টাগুলি চালায়। দুইপক্ষের গোলাগুলিতে খালি আসামিই মারা যায়। এইসব মিথ্যা গল্প, সাজানো মামলাও আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমাদের আসলে কিছু করার নেই।
গাঁজার নৌকা শুকনা নদী দিয়ে গেলেও চলে। কিন্তু এসপি হারুন গাঁজার নৌকা পাহাড়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের এসপি হারুন গত ৩১ অক্টোবর রাতে ঢাকা ক্লাব থেকে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের গাড়িটি আটক করে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যায়। পরদিন ১ নভেম্বর শুক্রবার মধ্যরাতে গুলশানের বাসা থেকে রাসেলকে না পেয়ে তার স্ত্রী ফারাহ রাসেল ও ছেলে আনাব আজিজকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরদিন শনিবার নারায়ণগঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্ধর্ষ এক গোয়েন্দা গল্প শোনান এসপি হারুন।
তিনি দাবি করেন, শুক্রবার রাত ৩টায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় চৌরঙ্গী ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে পুলিশ ধাওয়া করে শওকত আজিজের গাড়িটি আটক করে। গাড়ি থেকে থেকে ২৮টি গুলি, এক হাজার ২০০ ইয়াবা বড়ি, ২৪ বোতল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ, ৪৮ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে। ওই সময় গাড়িতে শওকতের স্ত্রী ও ছেলে ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করা হয়েছিল।
পরে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেম এবং তার অপর ছেলে আজিজ আল কায়সার টিটো নারায়ণগঞ্জ গিয়ে মুচলেকা দিয়ে ফারাহ রাসেল ও আনাব আজিজ ছাড়িয়ে আনে। তবে মামলা করা হয় রাসেল ও গাড়িচালকের নামে। তবে সমস্যা হয়ে যায় রাসেল তার ফেসবুকে তার স্ত্রী-সন্তানকে আটকের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করলে। ফুটেজে দেখা যায়, ৫০ থেকে ৬০ জন পুলিশ মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ফারাহ রাসেল ও আনাব আজিজকে।
আর সাধারণ মানুষকে যেভাবে ফাঁসানো যায়, সেভাবে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ ও নাতিকেও যে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় ফাঁসানো যায় না, এটা বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন হারুন অর রশিদ। ক্ষমতার কারণে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন আইন। নিয়ম হলো, নিজেদের এলাকার বাইরে গিয়ে অভিযান চালাতে হলে স্থানীয় পুলিশকে জানাতে হবে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ঢাকায় দুই দফায় অভিযান চালিয়ে একটি গাড়ি এবং দুজন মানুষকে তুলে নিয়ে গেলেও শাহবাগ বা গুলশান পুলিশকে কিছুই জানায়নি।
শওকত আজিজ রাসেল দাবি করেছেন, হারুন অর রশিদ আগে থেকেই তার কাছে চাঁদা দাবি করে আসছেন। এ নিয়ে বিরোধ পুরোনো। ২০১৬ সালের ৫ মে তিনি পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে, শুধু শওকত আজিজ রাসেল নয়, এসপি হারুনের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন আরও অনেক ব্যবসায়ী। ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি। এসপি হারুন সাম্রাজ্যের পতনের পর অনেকেই মুখ খুলছেন।
হারুন অর রশিদ নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছিলেন। সেটা অবশ্য আজ থেকে নয়, ২০১১ সালের ৬ জুলাই বিরোধী দলের কর্মসূচির সময় মানিক মিয়া এভিনিউতে জাতীয় সংসদের তখনকার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেন তখনকার এডিসি হারুন অর রশিদ ও এসি বিপ্লব কুমার সরকার। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সময় একজন জনপ্রতিনিধিকে রাজপথে পিটিয়ে প্রায় উলঙ্গ করে ফেলার ঘটনায় এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়েছে উল্টো। এ দুজনই সরকারের বাহবা পেয়েছেন, পদক পেয়েছেন। তারপর থেকেই এই দুজন সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
বিপ্লব কুমার সরকার নেতৃত্ব দিতেন পুলিশের বদলি সিন্ডিকেটের। আর হারুন অর রশিদ সাম্রাজ্য গড়েছিলেন প্রথমে গাজীপুর এবং পরে নারায়ণগঞ্জে। সীমা লঙ্ঘনের পরিণতি আগেই ভোগ করছেন বিপ্লব কুমার সরকার। তাকে রংপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পেটানোর ঘটনায় লাই না দিলে এ দুজন দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তার এই পরিণতি হতো না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগুলে এ দুজনই পুলিশের সম্পদ হতে পারতেন। আজ এ দুজনের জন্য পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
বিরোধী দলীয়চিফ হুইপকে পিটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ায় হারুন অর রশিদ হয়তো ভাবছিলেন, যা ইচ্ছা তাই করে পার পাওয়া যাবে। হয়তো ভেবেছিলেন বিএনপি নেতা এম এ হাসেমের পরিবারকে হয়রানি করলেও পার পওয়া যাবে বা আরও বাহবা মিলবে। তবে হারুন অর রশিদ এখন পর্যন্ত যথেষ্ট ছাড় পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তাতে তার নিছক প্রত্যাহার নয়, আর বড় শাস্তি হতে পারত। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের তদন্ত হবে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে বিদায়ের সময় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন হারুন অর রশিদ। কিন্তু তার কান্না কাউকে স্পর্শ করেনি। হারুন অর রশিদের পরিণতি থেকে আমাদের সবারই শিক্ষা নেয়া উচিত। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না, এটা মনে রাখলে সবার জন্যই মঙ্গল। পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে আইনের আওতায়। রাজনীতি, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, অন্যায় সুবিধার লালসায় যেন পুলিশ তার দায়িত্ব ভুলে না যায়। পুলিশ যেন জনগণের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে ওঠে।
এইচআর/বিএ/পিআর