ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘অনুপ্রবেশকারী’র সংজ্ঞা কী

আমীন আল রশীদ | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ০৫ নভেম্বর ২০১৯

রাজনীতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দটি বহু পুরনো এবং বিতর্কিত টার্ম। কে কখন কীভাবে একটি দলে প্রবেশ করেন এবং কখন তার এই প্রবেশকে অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে—সেটি পারিপার্শিক অনেক কিছুর উপরে নির্ভর করে। এই চিহ্নিত করার সর্বজনগ্রাহ্য কোনো মানদণ্ড নেই। সবশেষ ক্যাসিনোবিরোধী বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি’ অভিযান শুরুর পর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফে এই শব্দটি পুনঃপুন উচ্চারিত হচ্ছে।

সবশেষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাদের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের তত্ত্বাবধানে করেছেন। তারা যাতে আওয়ামী লীগের কোনো পদপদবিতে আসতে না পারেন, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। এই তালিকায় দেড় হাজারের মতো অনুপ্রবেশকারীর নাম রয়েছে বলেও জানান ওবায়দুল কাদের। এই তালিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, দলের কোনো পর্যায়ের নেতৃত্বে যাতে অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত বা অপকর্মকারীরা আসতে না পারেন।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান, যেটিকে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান—তাতে ক্যাসিনো পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃতদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত হলেও আওয়ামী লীগ তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী বলে দাবি করছে। বলা হচ্ছে, গ্রেপ্তারকৃতরা আগে বিভিন্ন সময় অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এখন প্রশ্ন উঠছে, ধরা পড়ার পরেই কেন এদের অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে? তারা যদি সত্যিই অনুপ্রবেশকারী হয়ে থাকেন এবং তাদের কর্মকাণ্ড যদি দল ও সরকারের জন্য ক্ষতিকর বলেই বিবেচনা করা হয়, তাহলে এতদিন তারা কীভাবে এই কাজগুলো করলেন এবং সেটি কাদের ছত্রছায়ায়? এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কারো পক্ষে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব নয়। আবার এই টাকা তারা যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সহায়তায় আয় করেন, সেই ক্ষমতাবানদের একটি মোটা অংকের টাকা দিতে হয়। অবৈধ পথে আয় করা কোটি কোটি টাকা দিয়েই রাজনৈতিক দলের তহবিল গঠিত হয়। সুতরাং যাদেরকে অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে যদি যুবলীগে অনুপ্রবেশ করেও থাকেন, তারপরও এর দায় যুবলীগ তো বটেই, এমনকি আওয়ামী লীগও এড়াতে পারে না। কারণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকেই যে যুবলীগ নিয়ন্ত্রিত হয়, এটি গোপন কোনো বিষয় নয়। সুতরাং অপরাধ করে ধরা পড়লেই অনুপ্রবেশকারী, আর ধরা না পড়লে নিজস্ব লোক—এটি সাংঘর্ষিক।

অনুপ্রবেশকারী সব প্রভাশালী দলেই থাকে। এখানে অনুপ্রবেশকারী শব্দটিকে কখন কীভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটিও একটি মৌলিক প্রশ্ন। ধরা যাক একজন লোক একসময় বিএনপি করতেন। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন, তাহলে তাকেও অনুপ্রবেশকারী বলা হবে? আজকে যিনি আওয়ামী লীগ যুবলীগ বা ছাত্রলীগ করেন—জন্মের পরেই তিনি এইসব দল ও সংগঠনের কর্মী হননি। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে সংগঠনে যুক্ত হতে হয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে কথা বলা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, অনু্প্রবেশকারীরাই সব অপরাধ করেন এবং যারা আওয়ামী লীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ বা অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের আগে অন্য কোনো দল করেননি বা পারিবারিকভাবেই এসব দল ও সংগঠনের সাথে যুক্ত, তারা সবাই ধোয়া তুলশিপাতা—তা তো নয়।
একজন লোক যখন অপরাধ করেন, তখন তার প্রধান পরিচয় অপরাধী। তিনি অনুপ্রবেশকারী নাকি বাইবর্ন সেই দলের লোক, সেটি মুখ্য নয়। আবার একজন লোক আজ একটি দল করছেন বলে কাল আরেকটি দলে যেতে পারবেন না, এমন কোনো নিয়মও নিশ্চয়ই কোনো দলের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ নেই। প্রতিটি দলের কিছু নীতিমালা থাকে। সেই নীতিমালা মেনে যেকোনো লোকই সংগঠনের সদস্য হতে পারেন। একসময় জামাত করতেন, তাকে নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আওয়ামী লীগ সদস্য করবে না—এটি স্বাভাবিক। কিন্তু জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত প্রচুর লোক আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, এরকম অজস্র ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, জামাতের লোক কীভাবে কাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন? যারা এই সুযোগ দিয়েছেন তাদের বিচার হবে?

একটি দলে,বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলে নানা কারণে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রধানত দুটি কারণ মুখ্য। ১. ব্যক্তিগত লাভ ও লোভ এবং ২. প্রতিপক্ষ দলের স্বার্থ। অর্থাৎ যারা সুবিধাবাদী তারা যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের সাথে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। কখনো পদপদবি নিয়ে, কখন পদ ছাড়াই। দ্বিতীয় আরেক শ্রেণির লোক অনুপ্রবেশ করেন সেই দলের ক্ষতি করার জন্য। যেমন সচেতনভাবে জামায়াতের কোনো লোক যদি আওয়ামী লীগে যোগ দেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের নীতি আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নয়, বরং দলের ভেতরে থেকে আওয়ামী লীগের খোঁজ-খবর নেয়া এবং সুযোগ মতো আওয়ামী লীগের ক্ষতি করাই তার উদ্দেশ্য। এখন ওবায়দুল কাদের যে দেড় হাজার অনুপ্রেবশকারীর তালিকা আছে বলে জানিয়েছেন, সেখানে কারা আছেন এবং কীসের ভিত্তিতে তাদের অনুপ্রবেশকারী বলছেন, সেটি এখনও পরিস্কার নয়।

লক্ষ্যণীয় যে, ওবায়দুল কাদের এখানে তিনটি শব্দ বলেছেন—অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত এবং অপকর্মকারী। অর্থাৎ কেউ অনুপ্রবেশকারী না হয়েও যদি তিনি বিতর্কিত হন এবং অপকর্মের সাথে জড়িত থাকেন তাহলে তিনি দলের কোনো পদ পাবেন না। যদি আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে তাহলে এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে, এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্র ও তৃণমূলে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো কমিটি হবে। কারণ যদি সত্যি সত্যিই অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত এবং অপকর্মকারীদের বাদ দিয়ে কেন্দ্র ও তৃণমূলে কমিটি করা যায় তাহলে সেসব কমিটিতে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ, সৎ ও যোগ্য লোকেরাই পদ পাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তিন শ্রেণির লোক বাদ দিলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোয় কতজন লোক টিকে থাকবেন?

যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কী করেন, তা দেশবাসীর অজানা নয়। বছরের পর বছর এইসব কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রাজনীতির ব্যাপারে যে একটা বিতৃষ্ণা বা বিরক্তি তৈরি হয়েছে। যে কারণে সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৎ ও ভালো মানুষ বলতে যাদের বোঝায়,তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। সুযোগ পেলে বড়জোর তারা একটা ভোট দিয়ে আসেন। তাদের অনেককে জোরাজুরি করেও রাজনীতিতে আানা যায় না। এমনকি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কোনো ভালো কাজেও তারা আসতে চান না। সুতরাং বিতর্কিত এবং অপকর্মের সাথে জড়িত নন—এমন লোকের বাইরে গিয়ে কমিটি হয়তো করা যাবে, কিন্তু এটা করতে গেলে বা সত্যি সত্যিই এটি করা গেলে দলের বিশাল একটি অংশ ছিটকে পড়বে—যারা বছরের পর বছর দলকে নানাভাবে সুবিধা দিয়েছে; মিছিল মিটিংয়ে লোকবল দিয়েছে; ভোটের সময় দলকে চাঁদা দিয়েছে; বিরোধী পক্ষ দমনে ক্যাডার ও অস্ত্র দিয়েছে। সুতরাং এই বিপুল সংখ্যক লোককে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও ভালো মানুষদের নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় দলের কমিটি হবে, এটা ভাবতে যতটা ভালো লাগে, বাস্তবতা ততই কঠিন।

তবে হ্যাঁ, একটি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা যখন বলেন যে তারা বিতর্কিত ও অপকর্মকারীদের বাদ দিয়ে কমিটি করতে চান, সেটিও একটি বড় অর্জন বা অগ্রগতি। তার মানে কোথাও একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। সেটি কতটা স্থায়ী বা কার্যকর হবে তা হয়তো সময়ই বলে দেবে, কিন্তু দলের সিনিয়র নেতারা যদি সত্যিই এটি বিশ্বাস করেন বা উপলব্ধি করেন যে, ভালো মানুষেরা দলের পদপদবি পাবেন, তাহলে এটি সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনৈতিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে। দেশের রাজনীতি সত্যি সত্যিই দুর্বৃত্তায়নমুক্ত হোক—এই প্রত্যাশা নিশ্চয়ই আমাদের সবার। কিন্তু এও ঠিক, কথাটা বলা যত সহজ, করা ততই কঠিন।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এইচআর/এমকেএইচ