বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল ফেসবুক
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ আর বিএনপিতে বিভক্ত ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি বিরোধী দল। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় এই চক্র ভেঙে যায়। সংসদে বিরোধী দলের আসনটি দখল করে নেয় জাতীয় পার্টি। অবশ্য ক্ষমতাসীন মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলা হতো।
নজিরবিহীনভাবে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে সংসদ থেকে হারিয়ে যায় বিএনপি। আর সেই ভুলের খেসারত দিতে দিতে রাজপথ থেকেও হারিয়ে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে হারানো অবস্থান ফিরে পেতে চাইলেও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সরকারের অংশ জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল। মাত্র ছয়টি আসন নিয়ে বিএনপি সংসদে ধুঁকছে। তাই কার্যত দেশে এখন কোনো বিরোদী দল নেই- না সংসদে, না রাজপথে।
কিন্তু প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। বাংলাদেশে বিরোধী দলের শূন্যস্থান পূরণ করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। এখন বাংলাদেশে যা কিছু ঘটুক, ফেসবুকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়, প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। সুখের কথা হলো, ফেসবুকে গড়ে ওঠা জনমতকে সরকার উপেক্ষা করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। ফেনীর নুসরাত, বরগুনার রিফাত, বুয়েটের আবরার হত্যাসহ সাম্প্রতিক অনেক ঘটনায় প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে ফেসবুকের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের কারণে।
ফেসবুকের কারণে কী কী হয়েছে তার তালিকা অনেক লম্বা। সর্বশেষ রাগের মাথায় প্রতিবেশীর ছাদবাগানের গাছ কাটার অপরাধে সাভারে এক নারীকে কারাগারে যেতে হয়েছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ফেসবুকে গাছ কাটার ছবি ভাইরাল না হলে এই নারীর কিছুই হতো না। এমনকি যার গাছ কাটা হয়েছে, তিনি কারও কাছে এই ঘটনার বিচারও দিতে পারতেন না। তাৎক্ষণিকতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বরাবরই গণমাধ্যমকে ছাড়িয়ে যায়। এমনকি কখনো কখনো প্রভাবেও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো বিশ্বাসযোগ্যতায়। গণমাধ্যমের ন্যূনতম হলেও দায়িত্বশীলতা আছে, জবাবদিহিতা আছে; কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো ছাড়া গরু; কখন কী করবে, কোথায় যাবে; তার ঠিক নেই। কোনো দায়িত্বশীলতা নেই, কারও কাছে জবাব দিতে হয় না। তাই ফেসবুক হলো আমাদের সবার যেমন ইচ্ছা লেখার কবিতার খাতা। ফেসবুক খুললেই একটা প্রশ্ন আসে, Whats on your mind? মানুষও মনের সুখে ফেসবুকে মনের কথা লেখে। সমস্যা হলো, কারও কারও এই মনের সুখ, অনেকের ঘরে আগুন জ্বালায়।
ফেসবুককে যেহেতু কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তাই এখানে নিউজের সাথে ঘুরে বেড়ায় গুজব, সত্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে মিথ্যা। এমন বিভ্রম তৈরি হয়, সত্য-মিথ্যা আলাদা করা যায় না। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি যথেষ্ট দায়িত্বশীল ছিল না, তাদের উত্তরসুরী ফেসবুকও দায়িত্বশীল নয়। ফেসবুকে ছোট একটা গুজব ঘটাতে পারে অনেক বড় বিপর্যয়। ভোলার সাম্প্রতিক ঘটনাই প্রথম নয়। এর আগেও রামু, নাসিরনগর, গঙ্গাচড়ায় ফেসবুকের গুজবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও ফেসবুক হ্যাক করে ধর্ম অবমাননা করা হয়েছে। তারপর একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে সেই গুজবকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে।
এটা অনেক পুরোনো, কিন্তু কার্যকর কৌশল। আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের একটা সমস্যা হলো, তারা চিলে কান নিয়েছে, এটা শোনার পর তারা কানে হাত না দিয়েই চিলের পেছনে দৌড়াতে থাকেন। ভোলায় অভিযুক্ত বিপ্লব থানায় গিয়ে তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করার অভিযোগে জিডি করেছেন। পুলিশ তাকে আটকও করেছে।
তারপরও বিপ্লবের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। সেই বিক্ষোভ থেকে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। সংঘর্ষে চারজন মারা গেছেন। প্রত্যেকটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। কিন্তু এই চারজনের মৃত্যুর কারণটি আরও বেদনাদায়ক। কিছু না জেনে কোনো কারণ ছাড়াই তারা সবচেয়ে মূল্যবান জীবনটি উৎসর্গ করলেন। তাদের পরিবার এখন কী দিয়ে সান্ত্বনা পাবে? শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশেই ধর্ম সবচেয়ে সহজ অস্ত্র। যেকোনো কাজে ধর্মকে ব্যবহার করা যায়। জানি না কারা, তবে ভোলায়ও একটি মহল ধর্মকে ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। আংশিক সফল হলেও পুরোটা পারেনি। একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না, আমাদের দেশের মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস এত ঠুনকো কেন? কোনো একটা হ্যাক করা আইডি থেকে কিছু একটা ছড়ানো হলেই তাদের ধর্ম অবমাননা হয়ে যায়। ইসলাম তো এত হালকা ধর্ম নয়।
তবে আমাদের ফেসবুক ব্যবহারে আরও অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। ফেসবুক এখন আমাদের প্রধান বিরোধী দলই নয় শুধু, আমাদের জীবনের নিত্যদিনের অংশ হয়ে গেছে। তাই ফেসবুক ছাড়া আর আমাদের চলবে না। তাই ফেসবুক দরকার নেই, বন্ধ করে দেন; এসব বলে লাভ নেই। আলোচনা করতে হবে, কীভাবে নিরাপদ ফেসবুকিং করা যায়। একসময় অসম্ভব মনে হলেও দেশের সব মোবাইল এখন নিবন্ধিত। ফেসবুকের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো একটা কৌশল বের করতে হবে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার আইডির পরিচয় নিশ্চিত করতে পারে। ফেসবুক যাতে এনআইডি বা ফটো আইডি ছাড়া কাউকে আইডি খুলতে না দেয়। সবধরনের ফেক আইডি বন্ধ করতে হবে।
ফেসবুক সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই, ফেসবুক আইডি সুরক্ষার সক্ষমতা নেই; এমন কেউ যেন আইডি খোলার সুযোগ না পায়। তারপর ফেসবুকের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, সরকারের বিরোধিতা করার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অবাধ সুযোগ থাকতে হবে। তবে কেউ যেন গুজব ছড়াতে না পারে, ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াতে না পারে।
সবার ফেসবুকিং নিরাপদ ও আনন্দময় হোক।
এইচআর/বিএ/পিআর