ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের অভিন্ন রূপ
‘সরকার কি পুরো টার্ম থাকতে পারবে?’ ‘যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হতে পারে।’ ‘পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল ও নাজুক।’ উল্লিখিত কথাগুলো বিশেষ মহলে এখানে-ওখানে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। প্রায় একই ধরনের কথা খোদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও বলছে। ১৬ অক্টোবর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৩০ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে সরানোর নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বলেছিলেন, ১/১১-এর প্রয়োজন নেই। আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, যাতে ১/১১ মতো কোনো ঘটনা দেশে না ঘটতে পারে।
যতটুকু মনে পড়ছে, বিগত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে কে যেন বলেছিলেন, ষড়যন্ত্র শুধু জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে হচ্ছে না, দলের ভেতরেও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। রাষ্ট্রের ক্রাইসিসে এসব ষড়যন্ত্রকারীর অবস্থা পরিষ্কার হয়ে যায়। বর্তমানে অবশ্য এই ধরনের কোনো কথা দলীয়ভাবে কেউ বলছেন না। এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে তো অনেক সময়েই ১৫ আগস্টের মতো ঘটনার হুমকি দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৩ অক্টোবর ড. কামাল প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে এবং পুনরায় নির্বাচন দিতে বলছেন। বিএনপির সঙ্গী গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া সরকারের পদত্যাগ ও জাতীয় সরকার গঠনের দাবি তুলে বলেছেন, এ সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে। সিপিবি নেতা মনজুরুল আহসান খান জাতীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। এমন এক সময় উল্লিখিত সব কথা বলা হচ্ছে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছে।
এই অভিযানে ক্যাসিনো কাণ্ডের পাণ্ডা যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে প্রেপ্তার এবং সভাপতিসহ কয়েকজনকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা রিমান্ডে গিয়ে এই কাজে সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগের কতক নেতাসহ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নাম বলছেন বলে জানা যাচ্ছে। আকারে-ইঙ্গিতে এসব নেতা বা কর্তাব্যক্তি কারা তাও দেশবাসী অনুমান করতে পারছে। মতিঝিল এলাকার এমপি ক্ষমতাসীন জোটের বর্ষীয়ান বামনেতা রাশেদ খান মেননের নামও এতে উঠে এসেছে। এর আগে টেন্ডার বাণিজ্য কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংগঠন থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
এসবের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের চুক্তির প্রেক্ষাপটে ঘটেছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। তাতে ছাত্রলীগের ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারাও রিমান্ডে গিয়ে নানা ধরনের কথা বলছেন। শিক্ষাঙ্গনে ‘টর্চার সেল’ এখন এক বিভীষিকা। এসবের মধ্যেই চলছে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রস্তুতি এবং নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে জানা যাচ্ছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে বোঝা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনে এখন এক ধরনের বিরাট অস্থিরতা বিরাজ করছে। ছাত্র আন্দোলন-সংগঠন থাকা বা না থাকা নিয়ে সরকার এতটাই রক্ষণাত্মক হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ চাইলে ছাত্ররাজনীতি-সংগঠন বন্ধ করতে পারে। তেমনটাই সেখানে হয়েছে এবং তা আরো আরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হতে পারে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর চুক্তি নিয়ে নতুন করে ভারত বিরোধিতা চাঙ্গা হয়ে উঠছে। দেশ বিক্রির কথাটা আবার উঠছে। অতীতের ধারার বাইরে গিয়ে বিএনপি এতদিন ভারত নিয়ে নিশ্চুপ ছিল এবং নেতাদের অনেকেই ভারতে গিয়ে বিভিন্ন সরকারি মহলে ধরনা দিয়েছেন। সম্প্রতি চুক্তির প্রেক্ষাপটে বিএনপি আবারও ভারত বিরোধিতায় নেমেছে। অবশ্য এই বিরোধিতার মাত্রা কোন পর্যায় পর্যন্ত যাবে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। সিপিবিও ভারতের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী অসম চুক্তি বাতিলের জন্য দাবি তুলছে। এদিক-ওদিক কান পাতলে শোনা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জাতীয় মূলধারার সচেতন জনগণের মধ্যে সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন ও কথাবার্তা রয়েছে। সব আমরা দিয়ে দিচ্ছি, ভারত থেকে কিছু পাচ্ছি না এই ধরনের এক ভাবনা কমবেশি ক্রমে পরিব্যপ্ত হচ্ছে। এতে ভারত নিয়ে আক্রমণাত্মক প্রচার চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবাদ সম্মেলনে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়ে বলতে হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ শেখ হাসিনা বিক্রি করবে তা হতে পারে না।’
প্রসঙ্গত সেই পাকিস্তান আমল থেকে দেখা গেছে ভারত বিরোধিতার অনুষঙ্গ হচ্ছে দেশে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও উত্তেজনা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিগত নির্বাচনের পর সাম্প্রদায়িক গোলযোগ ও হামলার মাত্রা কমতির দিকে ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ভারত বিরোধিতার সঙ্গে মিলে তা নতুনভাবে দানা বেঁধে উঠছে। ইতোমধ্যে ভোলায় ফেসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ওই পোস্টটি অতীতের অনেকগুলোর মতোই ছিল ফেসবুক হ্যাকিং করে পরিস্থিতি সৃষ্টি করার নীলনকশা বিশেষ। বাস্তবে তৌহিদী জনতার নামে বিশাল সমাবেশের ভেতর দিয়ে সেখানে লঙ্কাকাণ্ড ঘটানোর পাঁয়তারা হয়েছে। এতে একজন পুলিশসহ চারজন নিহত ও বহু আহত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করত তবে কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সেখানে সৃষ্টি হতো, তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। সেখানে উত্তেজিত জনতা পুলিশকে অবরুদ্ধ করে।
এ ঘটনায় যথাসময়ে যথাযথভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত কথা বলতে ও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। হ্যাকিং ঘটনা জানার পরও এমন ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, ধর্মপ্রাণ মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতার বারুদ কোন পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে ইসকনসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠন নিয়ে নানা ধরনের প্রচার চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে তাকে ইসকন সদস্য প্রমাণ করার নানা প্রচেষ্টা চলছে। এদিকে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবকরা নাকি ভারতের আরএসএসের উস্কানিতে প্রতিরোধের নামে সংগঠিত হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না সাম্প্রদায়িক আর সেই সঙ্গে ভারত বিরোধিতায় পরিস্থিতি এখন বেশ নাজুক।
এদিকে দুর্নীতি নিয়েও সরকার আছে বেশ চাপে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার ঘটনা থেকে মানুষের মনে এমন আতঙ্ক দানা বাঁধছে, জিনিসপত্রের দাম যখন-তখন লাগামহীন হতে পারে। ব্যাংক বিশেষত ঋণখেলাপিদের সরকার ছাড় দিচ্ছে নিয়েও মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের সুদ কমায় মানুষ হতাশ হচ্ছে। এসবের মধ্যে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি ও বিদেশিদের প্রশংসা নিয়ে আগে যেমন একটা উচ্ছ্বাস ছিল তা কমছে। বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে বিগত সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারি জোটের নেতা রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের পর রাজনীতির স্থিতিশীলতা নিয়েও গণমনে শঙ্কা কাজ করছে।
এই যখন অবস্থা তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে সাধারণভাবে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর সময়কাল নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হয়। এই কলামেও ওই সময়ের সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির তুলনা করে কখনো আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘটনা ঘটেছিল সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগে। তখন দুই তন্ত্র বা কেন্দ্রিক টানাপড়েনে বিশ্বপরিস্থিতি অস্থির থাকলেও একটা ভারসামস্যমূলক অবস্থান ছিল। কিন্তু এখনকার বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। তাই সেই সময়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমানের মিল খোঁজা হলেও তা পুরোপুরি মিলবে না।
তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কী ধরনের অবস্থা দাঁড়ায় এর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিতে আমরা ১৯৯৬-২০০১ শাসনামলের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিতে পারি। যদিও ওই সময়ের চেয়ে বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ও টানাপড়েন প্রবল হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে যেমন তেমনি বিশেষভাবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রবল হয়েছে। আণবিক বোমা না থাকলে যুদ্ধাবস্থা কোন পর্যায়ে যেত তা ভাবলে কূলকিনারা পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি দুই আণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান যেভাবে এই মারণাস্ত্র নিয়ে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, তা নিয়ে ভাবলে শিরদাঁড়া সোজা রাখা কঠিন বৈকি!
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ ফিরে এলে পরিস্থিতি ছিল উৎসাহউদ্দীপক। সর্বজনগ্রাহ্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, বিএনপির প্রতি জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে যোগদানের আহ্বান, পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের ইতিহাসে প্রথম বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী শামসুল ইসলাম খানকে স্পিকারের আসন গ্রহণ করানো, সংসদীয় কমিটিগুলো সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে কাজ করতে থাকা, স্পিকারের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথাও এখানে স্মরণ করতে হয়। প্রভৃতি ছিল জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার ক্ষেত্র সৃষ্টির উজ্জ্বল ও অনন্য উদাহরণ। কিন্তু গোল বাধে কতক কারণে।
৩১ আগস্ট ১৯৯৭, ধানমণ্ডি থানায় ১৩ জনকে আসামি করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ১২ নভেম্বর সংসদে পাস করা হয় ইনডেমনিটি বাতিল বিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুরু হয়। বিজয়ের মাসে বাংলাদেশ-ভারত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১০ মার্চ সরকার ও পার্বত্য জনসংহতি সমিতির দ্বিতীয় দফা বৈঠকে অস্ত্র বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৮ সাল শুরু হয় ভারতের সেভেন সিস্টার উলফার নেতা অনুপ চেটিয়ার গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে। দ্রব্যমূল্য ঠিক রেখে খাদ্য ও বিদ্যুৎ ঘাটতিসহ নানা সংকট মোকাবেলা করে দেশ অগ্রসর হয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ ও তৎপরতা সব ভেস্তে যায়।
এসবই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে, তাই কারোরই অস্বীকার করা উপায় নেই। ১৯৯৮ সালে থেকেই পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ পেতে থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নজিরবিহীন তাণ্ডব সংঘটিত হয়। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ সরকার থেকে ভিন্ন অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। পরে এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে হয়, যদি তিনি চান তবে পদ ছেড়ে দিতে পারেন। শুরু হয় বিরোধী দলের সংসদ বয়কট ও রাস্তার আন্দোলন। শিক্ষাঙ্গনগুলো ছাত্রলীগ-ছাত্রদল কিংবা তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পরিস্থিতি এমন হয় যে, ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রশ্নোত্তরে বলেন যে, ‘সব দল একমত হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে রাজি এবং শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী দেখামাত্র গুলি করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও আপত্তি নেই। এদিকে মে মাসের মাঝামাঝি খালেদা জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিল নিয়ে উত্তেজনা করে বলতে থাকেন, ‘ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে’, ‘দেশ লেবানন-শ্রীলঙ্কার মতো গৃহযুদ্ধের দিকে যেতে পারে’ ইত্যাদি। ওই দিনগুলোতে খালেদা জিয়া গ্যাস ও তেল সম্পদ নিয়ে উত্তেজনাকর প্রচার চালান। জুন মাসে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকে আমেরিকার সঙ্গে গোপনে সোফা চুক্তি (স্টেটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট) করা হয় অপপ্রচার দিয়ে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নারীবাদী সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন ইস্যু সামনে এনে তথাকথিত মুরতাদ দেশদ্রোহিতার প্রচার তুঙ্গে তোলা হয়।
নভেম্বরে ভারতবিরোধী প্রচারণা যখন তুঙ্গে তখন ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে থাকে। ২৭ জানুয়ারি কলকাতার বইমেলার উদ্বোধনে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেলে সেখানে তাকে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করা হয়। ফলে সরকার বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। এই দিনগুলোতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সরকারের সমালোচনায় নামে। এরপর বিডিআর-বিএসএফের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। এই দিনগুলোতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহু প্রশংসিত হতে থাকেন। পার্বত্য শান্তিচুক্তি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার, ক্ষুধার বিরুদ্ধে অন্দোলনের জন্য সেরেস পুরস্কার, শান্তি নিকেতনের দেশিকোত্তম পুরস্কার প্রভৃতি পুরস্কার পান।
উল্লিখিত এক বছরের ঘটনাবলির সঙ্গে বর্তমান সময়ের ঘটনা প্রবাহ মিলিয়ে নিলে দেখা যাবে, পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় একই ধরনের অবস্থা বা ইস্যু যেন সামনে আসছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে তখনো যেমন দল বা জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে থাকা দলগুলো থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাযথ সহযোগিতা ও সমর্থন পাননি; এবারেও পাচ্ছেন না। যদি পেতেন তবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কিংবা দলের নেতাদের কেউ কেউ অনৈতিক ও জনবিরোধী কাজে জড়িত হতে পারতেন না। দল সহযোগিতা করলে ‘কাউয়া’ তাতে ঢোকে কীভাবে? ক্ষমতাসীন জোটভুক্ত ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নির্বাচন সম্পর্কে এমন কথা বলেন কীভাবে!
১৯৯৮-৯৯-এর উল্লিখিত ঘটনার পর কী হয়েছিল তা সবার জানা। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। জাতীয় ঐকমত্যের জোট ভেঙে গিয়েছিল। বিএনপির পার্টনার হিসেবে জামায়াত ক্ষমতায় এসেছিল। নির্বাচনে বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক পরিবারকে বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্যাডারদের কোপানলে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। ভারত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্যাস ও ট্রান্সসিপমেন্ট পায় না। পরেশ বড়ুয়া-রাজখোরদের অভয়ারণ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। ১/১১-এর জরুরি আইনের শাসন ও আর্মি ব্যাকড নিরপেক্ষ সুশীলদের সরকার ছিল এরই পরিণতি। গণতন্ত্র পুরোপুরি নির্বাসিত করে তখন মাইনাস টু ও কিংস পার্টি করারই তৎপরতা চলছিল। নিরপেক্ষ সুশীল যারা সমর্থন করেছিল, তাদেরও খুব একটা কম ভোগান্তি হয়নি। এসব অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে ক্ষমতাসীন দল-জোটের নেতাকর্মীরাসহ সবাই যথাযথ ভূমিকা রাখবেন, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : রাজনীতিক।
এইচআর/এমকেএইচ