আবরারই কি ছাত্ররাজনীতির শেষ বলি!
মেধায় এগিয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা-ই বুয়েটে পড়েন। কিন্তু তাদের অনেকের মেধার সাথে মননের কী বৈপরীত্য দেখলো বাংলাদেশ! যে কারণে আবরার ফাহাদ নামের আরেক মেধাবীকে অকালে হারালো দেশ। ফাহাদকে হত্যা করা হলো। কারা করলেন? তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মেধাবী ছাত্র! সেই হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের সাবেক ছাত্র-শিক্ষকরা শোকে-ক্ষোভে-হতাশায়-দ্রোহে সমবেত প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন; 'ফাহাদ নয়। হত্যা করা হয়েছে আমাদের বুয়েটকে।'
বুয়েটে আগেও প্রাণ ঝরেছে। রক্ত ঝরেছে। কিন্তু আবরার ফাহাদের প্রাণ যেভাবে কেড়ে নেয়া হলো, তা নাড়া দিলো গোটা দেশকে। সভ্য সমাজাকে। মানুষের মনে প্রশ্ন; আগামী দিনের বাংলাদেশ যাদের মেধার জোরে বলিয়ান হবে, বিকশিত হবে তারা কীভাবে এতটা নির্মম আর নিষ্ঠুর হতে পারে! পারে। কারণ, ক্ষমতার আগ্রাসী মনোভাব তাদের মননের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে তাদের হাতে ফাহাদ প্রাণ হারায়। 'বুয়েট নিহত' হয়!
বিবেককে বন্ধক রেখে, দলদাসে পরিণত হয়ে যদি শিক্ষকরা পদের করুণাপ্রার্থী হয়ে যান, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় প্রাণহীন ইট-পথরে গড়া প্রতিষ্ঠান। সেই সব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জন্য দরকার এখন ' করুণা বিদ্যালয়।' যেখানে দয়া-করুণা বিতরণ করা হবে। করুণা বিদ্যালয় বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কোন শব্দ নয়। তবে সেখানে সেই শব্দের ব্যবহার অন্যরকম ইতিবাচক অর্থে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, করুণা বিদ্যালয়-কে নেতিবাচক অর্থে লিখতে হচ্ছে।
বিশ্বে অনেক দেশে ইদানীং মানসিক সুস্বাস্থ্যের পাঠ দেয়া হয়। সেখানে দয়াও পাঠ্যক্রমের অংশ। কিন্তু কেবল দয়া বা করুণানির্ভর হয়ে নিজের পদ ধরে রাখার সুখ অনুভব করা বোকামী। তাতে তারা নিজেরাই প্রমাণ করেন তাদের মানসিক গঠনে সমস্যা আছে! তারা কীভাবে সমাজের মেধাবীদের মেধার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করবেন?
মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত এক প্রবণতা দয়া। কিন্তু আরবার ফাহাদ হত্যার পর অনেকের মনে প্রশ্ন, আধুনিক জীবনের স্বপ্ন নিয়ে যারা বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল তার কী ভাবে সেই প্রবণতা খর্ব করে এত নির্দয়তা নিষ্কাশন করলো? যারা করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন; দ্রুত সময়ে চার্জর্শিট দেয়া হবে। তবে সঙ্গে একটু যোগ করেছেন; 'বুয়েট প্রশাসন আরো সর্তক হলে হয়তো এই ঘটনা এড়ানো যেতো।' প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে আরো বেশি আশ্বস্ত হওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, মা হিসেবে তিনি খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কী আমরা ভাবতে পারছি, আবরারই হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার দাপট দেখানোদের শেষ ' বলি'! হয়তো বা। হয়তো বা না। বাকিটা সময় বলে দেবে।
তবে তার আগে গবেষণা জরুরি হয়ে পড়েছে অন্য একটা বিষয় নিয়ে। বাংলাদেশে কী সত্যি সত্যি-ই করুণা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে? যে বিদ্যালয় মানুষকে শিক্ষা দেবে দয়াসূচক কর্ম, চিন্তা, অনুভূতি ও সামাজিক মাধ্যমে অধিক মানবিক সমাজ নির্মাণে সচেষ্ট হয়ে ওঠার। এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, একটি রাষ্ট্রের দৃঢ় হবার জন্য নির্দয় হওয়ার প্রয়োজন নাই। কিন্তু আমরা কী দেখছি, যারা যখন দেশ শাসন করেছে সেই দল বা জোটের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে থাকা ছাত্র সংগঠন, ছাত্র রাজনীতির নামে কি নিষ্ঠুরতা, কি নিমর্মতা কি অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে গত কয়েক দশক ধরে। এদের হাত ধরে অনৈতিক, নিষ্ঠুর, নির্মম এক সমাজের বাসিন্দা হতে যাচ্ছে আগামী প্রজন্ম। আর সেই সমাজের খণ্ডিত চেহারা আমরা দেখছি বুয়েটে আরবার ফাহাদ হত্যাকান্ডের মধ্যে। কখনো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজিতে কিংবা ভিন্ন মত পোষণ করা ডাকসুর ভিপি নুরকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে পেটানোর মধ্যে দিয়ে!
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কেন, সমাজের অন্য জায়গাও একই চিত্র। ছেলেধরার সন্দেহ করে গণপিটানিতে মারা হচ্ছে কোন মাকে। ক্যাসিনোর নামে লুটে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ক্লাব পাড়াকে রাতারাতি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে ক্যাসিনো পাড়া। সব কিছু মিলিয়ে সরকার প্রধান বাধ্য হয়েছেন ঘরের মধ্যে থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে। কিন্তু সব কিছু কী প্রধানমন্ত্রী করে দেবেন? সব কিছু সামাল দিতে হবে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে! চারিদিকে তাকিয়ে আজ যে সমাজকে দেখতে পাচ্ছি; তাতে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, তীব্র অসহনশীলতারই জয়জয়কার। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
আবরারের মৃত্যুর পর বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ। ১৯ জন বহিষ্কৃত। তাতে বুয়েট হয়তো হানাহানির রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে খানিকটা মুক্ত হলেও হতে পারে। কিন্তু সমাজের বাকি অংশের কী হবে? রাজনীতিমুক্ত সমাজ স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। তবে সমাজ বদলের জন্য মানুষকে আর বেশি মানবিক হতে হবে। তা নাহলে আগামী দিনে অন্যরকম ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমরা কী সেদিকেই হাঁটছি?
লেখক: এডিটর দীপ্ত টিভি।
এইচআর/পিআর