‘উইপোকা’ দমনের মাধ্যমেই স্বপ্নপূরণ সম্ভব
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ‘ঘরের ভেতর’ থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। এই শুদ্ধি অভিযানকে অন্তকরণ থেকে সাধুবাদ জানিয়েছে এদেশের মানুষ। প্রতিদিন এক একটি অভিযান সম্পন্ন হয়, বেরিয়ে আসে সোনাদানা, টাকাপয়সা, মদ, ইয়াবাসহ নানা জাতের মাদকের খনি (!)। মানুষ প্রতিদিন এসব দেখে আর উৎসাহের সঙ্গে সাধুবাদ জানায়। এসব লোমহর্ষক অভিযান দেখে দেখে স্বস্তিও পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আবার আমার মতো কেউ কেউ হয়তো এরূপ ভেবেও হয়তো অবাক হয়ে যাচ্ছেন যে, এত টাকা আমাদের দেশে! শুধু টাকা আর টাকা! আমাদের দেশ ভরা এখন টাকা, মদ ও ইয়াবায়। মদ, ইয়াবা এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও কী অবাক বিস্ময়ে বোকার মতো ভাবি আমরা এখন টাকাও রপ্তানি করতে পারি!
একদা এই বাংলাদেশে গোয়াল ভরা গরু ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল- ছিল গোলা ভরা ধান। আর বিদেশে পাট রপ্তানি করে আয় হতো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। সেজন্য পাটের আরেক নাম হয়েছিল ‘সোনালি আঁশ’। সেসব আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানির মাধ্যমে আমরা শক্ত করেছিলাম আমাদের অর্থনৈতিক ‘তাগদ’ সক্ষমতা। সেই যুগ আর এই যুগ! সেই সময় আর এই সময়! যুগ পাল্টেছে, সময় পাল্টেছে, পাল্টে গেছে মানুষের সম্পদের ধরনও। একদা মানুষ অর্থবিত্তের মালিক হলে জমি কিনে কিনে কিংবা জবরদস্তিমূলক দখলের মাধ্যমে হয়ে উঠতো জমিদার কিংবা ভূঁইয়া! আর এখন অর্থবিত্তের মালিকরা ‘আকাশ’ কিনেন। আকাশের ফ্রিকোয়েন্সি কিনেন। তাই দিয়ে অর্থাৎ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আকাশের তরঙ্গ কিনে কিনে তারা ‘আকাশদার’ হিসেবে পরিচিত না হলেও টেলিভিশন চ্যানেল খুলে খুলে বিকল্প সব সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ইদানীং দেখছি ভূমি ও আকাশ থেকে অনেকের মন ওঠে গেছে! তারা এখন পাড়ায় মহল্লায় ক্লাবে সভা-সংঘের আড়ালে গড়ে তুলেছেন জুয়ার ব্যাবসা ‘ক্যাসিনো’ যে শব্দটি বাংলাদেশের আইনের কোনো পুস্তকে নেই বলে দাবি করেছেন মাননীয় আইনমন্ত্রী স্বয়ং।
শুধু ক্লাব বা সভা-সমিতি নয় কোনো কোনো ফ্ল্যাট-বাড়িতেও নাকি ‘ক্যাসিনো’র সন্ধান পাওয়া গেছে। আর তাই দেখে নিন্দুকেরা তির্যক ব্যঙ্গের সঙ্গে একে ‘কুটির শিল্প’ বলে মজা করতেও ছাড়েননি। যাই হোক, মানুষের সম্পদের ধরন পাল্টানোর সাথে সাথে তাই আমদানি রপ্তানির সামগ্রীর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। সমাজের কথিত ক্ষমতাশালীদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বাংলাদেশে এখন বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ও মদসহ নানা জাতের মাদকদ্রব্য আমদানি করা হয়। আবার এদের মাধ্যমেই চোরাই পথে ও অন্যায়ভাবে বিদেশে রপ্তানি তথা পাচার করা হয় এদেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকা!
বাংলাদেশ যে টাকার দেশ, বাংলাদেশ যে টাকায় স্বয়ংসম্পূর্ণ তা আমরা শুদ্ধি অভিযানের বদৌলতে দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা রপ্তানি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে- অবৈধ উপায়ে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে! এ টাকা রপ্তানি থেকে দেশে ‘আয়’ হয় না মোটেই। টাকা পাচারের মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি কেবল দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তোলা হচ্ছে। আর দৃশ্যত এক শ্রেণির মানুষের কাছে বিপুল অর্থ-সম্পত্তি পুঞ্জিভূত হওয়ার ফলে মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে। এত উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে এই ব্যবধান কাম্য হতে পারে না। এই বাস্তবতাটি জননেত্রী বাস্তবতার সঙ্গে উপলব্ধি করেছেন।
ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ব্যবহারের মাধ্যমে কিছুসংখ্যক মানুষ এদেশে টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছেন। বলা হচ্ছে এদের অনেকেই দলের মধ্যে বহিরাগত। কিন্তু বহিরাগত হয়ে দলের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানই শুধু নয়- দলীয় উচ্চ পদে আসীন কীভাবে হলেন সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে এসব পদ পাইয়ে দেওয়ার পেছনেও রয়েছে দলের ভেতরেই ‘সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেটের লোকেরাই দলের ভেতরকার শক্তিকে যেমন খুইয়ে ফেলছে তেমনি দলের বাহ্যিক ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবোধক করে তুলছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলার স্বপ্ন এবং উন্নয়নকেও করছে দুর্বল। তাই তিনি ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন তাঁর উন্নয়নকে উইপোকা খেয়ে ফেলছে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী ধরনের নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন তা আমরা তাঁর এরূপ আক্ষেপোক্তি থেকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধিজাত বিশ্বাস থেকে বর্তমানের শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা যেমন উজ্জীবিত হয়েছেন তেমনি উজ্জীবিত হয়েছেন রাজনীতি বিমুখ সাধারণ মানুষও।
আমরা লক্ষ করেছি জননেত্রীর এই একটি বক্তব্যের কারণেই সাধারণের মধ্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি। একথা উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, আওয়ামী লীগ কিংবা তার অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা উইপোকা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই সর্বস্তরের উন্নয়নে একদিকে যেমন গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে তেমনি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়াও ত্বরান্বিত হবে। দুর্নীতি দমনে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে ইংগিত দিয়েছেন তাতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। জননেত্রীর ওপর সাধারণের এই ভরসাটুকু অক্ষুণ্ণ রাখতে সকল প্রকার চেষ্টাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত সৈনিকদের করা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এই সোনার বাংলা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের এতদিনের সংগ্রামে যারা অন্তরায় হয়ে থাকবেন, যারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবেন, যারা কলুষিত করবেন, দল-মত-আত্মীয়-পরিবার আমি দেখতে চাই না। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার দরকার আমরা সেই পদক্ষেপ নেব।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এরূপ কথায় সত্যি সত্যিই চারদিকে অমোঘ উৎসাহের সাড়া পড়ে গেছে।
চলমান অভিযানে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। যদিও কোনো স্বস্তি নেই আওয়ামী লীগের ঘরের ভেতরকার অনেকেরই। অনেকেরই বলতে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি তাদের জীবনের স্বস্তি শেষ হয়ে গেছে যাদের জীবনের ষোলো আনাই অসৎ পথের উপার্জন রাতারাতি যারা ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’-এ পরিণত হয়েছেন! রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে ভদ্রবেশে সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও এরা অলংকৃত করেছিলেন। এখন সেই পদ রক্ষা নিয়েও শুধু স্বস্তিই হারিয়ে ফেলেননি তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত আইনি প্রক্রিয়ায় পড়ে যাবার আশংকায় আতংকে দিনগুজরান করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নিীতির বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছেন তাতে করে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের গলার পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে বলতে হবে। কারণ এবার তারা সেই উপভোগ্য সুখের প্রাসাদ থেকে নিশ্চয়ই নেমে আসবেন সাধারণ মানুষের কাতারে। সেখান থেকে আরো নিচেই নামতে হবে তাদেরকে।
আমরা প্রত্যাশা করবো কেবল রাজধানী কেন্দ্রিক কার্যক্রমের মাধ্যমেই এই শুদ্ধি অভিযানের সমাপ্তি ঘটবে না দেশব্যাপি এই অভিযানের কার্যক্রম বিস্তৃত হবে। কারণ দেশব্যাপি আওয়ামী লীগ এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের পদ-ধারী নেতাকর্মীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবির সাথে নিজের ছবি যুক্ত করে পোস্টার, ব্যানার টানিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব প্রতিপত্তি জাহিরের মাধ্যমেও অনেকেই বিগত কয়েক বছরে ‘টাকার কুমিরে’ পরিণত হয়ে উঠেছেন। কুমির নয় ভয়ংকর হাঙরই বরং বলা ভালো।
সকল পর্যায়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সক্রিয় থাকলেই কেবল বলা যায় কিংবা বলাটা সার্থক হবে যে, ‘ঘরের ভেতর’ থেকে শুদ্ধি অভিযান প্রকৃতই আরম্ভ হয়েছে। ‘দলীয় বা আত্মীয়’ বলে কোনো ছাড় নয়- সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাতে সাধারণ সম্পাদকের এই ঘোষণায় দেশের মানুষের মনের স্বস্তিবোধ আরো গভীরতর হয়েছে। মানুষ এখন শুধু এসব ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন দেখতে চায়। অভিযানের শুরুটা আমরা দেখলাম, আমাদের কাছে ভালো লেগেছে; পূর্বেই বলেছি স্বস্তির কথা- স্বস্তিও পেয়েছি অনেক। এদেশের গুটি কয়েক আতংকগ্রস্ত দুর্নীতিবাজ ছাড়া সাম্প্রতিককালের শুদ্ধি অভিযানে সকলেই স্বস্তি পেয়েছে। সকলের সমর্থনও আছে অকুণ্ঠ।
কেবল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ‘ঘরের ভেতর’ই নয় এই অভিযান চলুক সর্বত্র। সর্বস্তরের উইপোকা দমনের এই শুদ্ধি অভিযানের শেষে আমরা যেন একটি পরিশুদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারি- নিজের কাছে, দেশের কাছে, বিশ্বের কাছে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমকেএইচ