ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এবার ধরা হোক সম্রাটের বসদের

প্রভাষ আমিন | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ০৭ অক্টোবর ২০১৯

ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট শুধু নামে নয়; কাজে-কর্মে, চলাফেরা, আচার-আচরণেও সম্রাট। তবে তাকে একটা বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। সম্ভবত তার কারণেই দেশে একটা অতি প্রয়োজনীয় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং আওয়ামী লীগে একটা অতি প্রয়োজনীয় শুদ্ধি অভিযান চলছে। এ অভিযান কতদূর যেতে পারবে বা কোথায় গিয়ে থামবে জানি না। তবে যতটুকু হয়েছে, তাতেই দুর্নীতিবাজরা দৌড়ের ওপর আছে। আতঙ্কে অস্থির আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারীরা। সম্রাটকে ধন্যবাদ দিতে দেখে অনেকে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন। তবে সত্যিই এ অভিযান সম্রাটের সীমা লঙ্ঘনের কারণেই হয়েছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের যৌথ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। সে বৈঠকে ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে ‘মনস্টার’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এরপর আসে যুবলীগ প্রসঙ্গ। শেখ হাসিনা বলেন, এরা তো শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ। শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে সেদিনই যুবলীগ মাসব্যাপী কর্মসূচি শুরু করেছিল। এ প্রসঙ্গ উঠতেই যেন রাগে ফেটে পড়লেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী। তিনি বললেন, ‘চাঁদাবাজির টাকা হালাল করার জন্য আমার নামে মিলাদের কোনো দরকার নেই।’

শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগ এনে বলেন, ‘যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি করতে গিয়ে বেঁচে গেছে। এখন নাকি আরেকজন তিন গাড়ি ভর্তি অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে। এসব ক্যাডার বাহিনী পোষা বন্ধ করুন। কোনো অস্ত্রধারী ক্যাডার আমার দরকার নেই। আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে সবার আগে এরাই অস্ত্র নিয়ে পালাবে। দলের কোনো বিপদে এদের পাওয়া যাবে না। আপনারা যারা এগুলো লালন-পালন করেন, এসব বন্ধ করতে হবে। নইলে আমি যেভাবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমন করেছি, সেভাবে এগুলোও দমন করব।’

শেখ হাসিনা কথা রেখেছেন। কঠোর হাতে যুবলীগ নেতাদের বেআইনী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে গ্রেপ্তার এবং কয়েকটি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। এরপর থেকেই ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তোলপাড়। একে একে গ্রেপ্তার হয়েছেন জি কে শামীম, শফিকুল আলম ফিরোজ, লোকমান হোসেন ভুঁইয়ারা। কিন্তু ধরাছোয়ার বাইরেই ছিলেন ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। কিন্তু সব আলোচনার কেন্দ্রেই ছিলেন সম্রাট। জানা যাচ্ছিল, ক্যাসিনো শুধু নয়, পুরো ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ছিল সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর রাতেও দলবল নিয়ে কাকরাইলের অফিসে ছিলেন সম্রাট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি বিশাল বাহিনীর নিরাপত্তায় কাকরাইলের অফিসেই অবস্থান করেন।

অভিযান শুরুর দিন সাতেক পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। সম্রাটের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। বলা হয়, তিনি গোয়েন্দা নজরদারিতেই আছেন। শেষ পর্যন্ত সম্রাটের সাম্রাজ্যের পতন ঘটলো রোববার ভোর ৫টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরায়। সেখানে মুনির চৌধুরী নামে এক জামায়াত নেতার বাড়িতে ছিলেন সম্রাট, সাথে ছিল ঢাকা মহানগর যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান। মুনীর চৌধুরী ফেনীর পৌর মেয়র মো. আলাউদ্দিনের ভগ্নিপতি। আর আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগে এসেছিল জাতীয় পার্টি থেকে।

সম্রাটকে ধন্যবাদ জানানোর কারণটি এখনও পরিষ্কার হয়নি। সম্রাট দীর্ঘদিন ধরেই যুবলীগের অলিখিত ‘সম্রাট’। নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন যখন মহানগর যুবলীগের সভাপতি ছিলেন, তখন সম্রাট ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। শাওন ভোলার একটি আসন থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকা মহানগর যুবলীগের রাজনীতি থেকে সরে গেলে সম্রাট মহানগর যু্লীগের সর্বেসর্বা বনে যান। সাথে চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণও চলে আসে সম্রাটের হাতে। তবে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে নিজের সীমাটা বুঝতে পারেননি সম্রাট। আর সব নির্মাণাধীন ভবনের মত আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম থেকেও ১০ কোটি টাকা চাঁদা চেয়ে বসেন সম্রাট। বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কানেও যায়। তিনি নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যানকে বলেছিলেন, ‘আমি এবং রেহানা নিয়মিত আঞ্জুমানে মফিদুলে চাঁদা দেই। আর সম্রাট সেখান থেকে চাঁদা চেয়েছে। ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’ কিন্তু এক বছরেও সম্রাটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং সম্রাট যুবলীগের সেরা সংগঠক এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সেরা ইউনিটের মর্যাদা পেয়েছে। শেখ হাসিনার এক বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ১৪ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে। যার ফল আজ দেখছে দেশবাসী।

জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের মতই দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলছে। ১৮ সেপ্টেম্বর অভিযান শুরুর পর থেকে সম্রাট সম্পর্কে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা যেন রূপকথাকেও হার মানায়। হিন্দি সিনেমার গডফাদারদের মতই তার চালচলন। কাকরাইলে তার যে অফিস, সেখানে সম্রাট পর্যন্ত পৌঁছতে অন্তত পাঁচটি নিরাপত্তা তল্লাশি পেরুতে হতো। তিনি চলতেন বিশাল বহর নিয়ে, তাতে থাকতো সশস্ত্র ক্যাডার। আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে যতদূর বুঝতে পারি, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ একটা নিরাপত্তা পান বলে মনে হয় না।

সিঙ্গাপুরে তার বিলাসবহুল জীবন, ক্যাসিনো খেলার গল্পও চমকে দেয়ার মত। রাতে রাতে উড়ে যেতো কোট কোটি টাকা। পত্রিকায় দেখেছি, তিনি নাকি মাসে ৫০ কোটি টাকা চাঁদা পেতেন। তার ভাগ দলের ঊর্ধ্বতন নেতা, পুলিশ, প্রশাসন, এমনকি সাংবাদিকদের কেউ কেউ পেতেন বলেও শুনেছি। শুনেছি, টাকার একটা অংশ সংগঠনের কাজে ব্যয় করতেন, কর্মীদের পুষতেন, এমনকি গরীব মানুষদেরও দিতেন। তাই দলে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও তার এক ধরনের জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় সব যেন তাসের ঘর। তবে সম্রাট একজন ব্যক্তিমাত্র। রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়েই এই দানবরা তৈরি। কারা সম্রাটকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্রাট বানালো, কারা তাকে সেরা সংগঠক বানিয়ে যুবলীগকে ধ্বংস করলো, কারা তাকে লাই দিয়ে মাথায় তুললো, কারা সম্রাটের টাকার ভাগ নিতো, কারা সম্রাটেরও গডফাদার; তাদের সবাইকে ধরা হোক। এবারের অভিযান উপড়ে ফেলুক সব দুর্নীতির শিকড়।

এইচআর/এমকেএইচ