নিউইয়র্কে বঙ্গবন্ধু বইমেলা ও খুনি মোশতাকের প্রেতাত্মা প্রসঙ্গ
নিউইয়র্কে বঙ্গবন্ধু বইমেলা ২০১৯ সমাপ্ত হয়েছে। ২০,২১,২২ সেপ্টেম্বর তিনদিন ছিল এই বইমেলা। আমাকে এই বইমেলার উপদেষ্টার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। এছাড়া একজন শব্দশ্রমিক হিসেবে আমার সার্বিক সমর্থন ছিল জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যের এই বইমেলায়। বইমেলার আহ্বায়ক ছিলেন আবু রায়হান। সদস্য সচিব ছিলেন শিবলী সাদেক শিবলু। মুজিব বর্ষ উদযাপন পরিষদ এর আহ্বায়ক মিশুক সেলিম এবং সদস্য সচিব নুরুল আমিন বাবু।
মেলার শেষ দিনে, রবিবার রাতে যখন বইমেলা ভাঙার প্রস্তুতি চলছিল, তখন একটি ঘটনা সেখানে ঘটে। বলে রাখি, আমি 'ঘুংঘুর'-এর স্টল বন্ধ করে বইপত্র নিয়ে রাত সোয়া নয়টার দিকে মেলাস্থল ত্যাগ করি। এর পরেই ঘটে ঘটনাটি। গণজাগরণ মঞ্চের শিল্পী আল আমিন বাবু সেখানে এসে একটি বই দেখিয়ে প্রতিবাদ করেন। তিনি 'রাজা দরশন' বইটির কথা উল্লেখ করে তীব্রভাবে বলেন, 'এই বইয়ের লেখক আবু রায়হান বঙ্গবন্ধু বইমেলার আহ্বায়ক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। কারণ তিনি খুনি মোশতাক আহমদের সাথে দেখা হওয়ার স্মৃতিটিকে 'রাজা দরশন' বলে বিবেচনা করেছেন। সেই আলোকেই আত্মগদ্য লিখেছেন। আপনি খুনি মোশতাকের প্রেতাত্মা।'
আল আমিন বাবুর প্রতিবাদের ভিডিওটি ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যা অনেকের মতো আমিও দেখেছি। এখন আসি এই 'রাজা দরশন' বইটি বিষয়ে। কী আছে এই বইটিতে? বলে রাখি, বইটি ২০১৪ সালের ঢাকা বইমেলায় প্রকাশিত হয়। এটি বের করেছে 'সময় প্রকাশন'। যার কর্ণধার বিশিষ্ট প্রকাশক ফরিদ আহমেদ। নিউইয়র্কে আসার পরপরই 'রাজা দরশন' বইটি আমাকে দিয়েছিলেন স্বয়ং লেখক আবু রায়হান। আমার পড়া হয়ে উঠেনি। এই প্রতিবাদের পর, তা পড়ার প্রয়োজন বোধ করি। বইটির প্রথম লেখাটির নাম 'রাজা দরশন'।
আবু রায়হান ওপি ওয়ান ভিসা পান। একদিন তিনি ইত্তেফাক পত্রিকা পড়তে পড়তে একটি বিজ্ঞাপন দেখেন। সেই বিজ্ঞাপনটি ছিল, 'নিউইয়র্কে একটি হোটেলে চাকুরির জন্য ওপি ওয়ান পাওয়া লোক দরকার। অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেয়া হবে।' এই বিজ্ঞাপনের জের ধরেই আবু রায়হান ঢাকায় একটি বাসায় যান। সেখানে গিয়ে একজন বৃদ্ধের দেখা পান। জানতে পারেন ওই বৃদ্ধের ছেলে বিজ্ঞাপনটি দিয়েছে। বৃদ্ধ, আবু রায়হানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। ধরেই রাখেন। বৃদ্ধ বলেন-'তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো?'
আবু রায়হান বলেন- না। বৃদ্ধ বলেন-'আমি খন্দকার মোশতাক আহমদ। বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট।' (পৃষ্ঠা-১৫)
তার লেখা এভাবেই শেষ হয়ে যায়। বইটি নিয়ে আরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- আবু রায়হান বলতে চেয়েছেন-
১। খুনি মোশতাক একজন স্নেহশীল মানুষ। মোশতাক কি করেছেন তা ইতিহাস, মহাকাল বিচার করবে।
২। মোশতাক দাবি করেছে, সে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট।
৩। রায়হান মোশতাককে রাজা তুলনা করে আখ্যান লিখেছেন।
৪। এই আত্মগদ্য ছাপেন'নি সাপ্তাহিক বাঙালি সম্পাদক কৌশিক আহমেদ।
এটা ছাপেন'নি প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌস। (পৃষ্ঠা-২১) তা রায়হান নিজেই লিখেছেন তার দ্বিতীয় বয়ানে।
৫। অন্য এক লেখায় প্রকারান্তরে তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিব বলেছিলেন, 'আমরা ওদের ভাতে মারবো,পানিতে মারবো' অথচ আমরা সবাই জানি পাকিস্তানিরা ভাত খায় না, রুটি খায়। (পৃষ্ঠা- ২৬-২৭)
এই বইটিতে আরও কিছু চরম বিতর্ক এনেছেন আবু রায়হান। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সঠিক কোনো জন্মইতিহাস নেই। যে যার মতো করে লিখেছে। আরও লক্ষ্যণীয় বিষয় গুলো হচ্ছে- মোশতাক নিজেকে প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবি করার পর তিনি প্রতিবাদ করেন নি কেন? সেই সময় না পারলে তিনি বইয়ে এর ব্যাখ্যা দেন নি কেন? কৌশিক আহমেদ ও হাসান ফেরদৌস এই লেখা খারিজ করার পরও তিনি বই ছাপলেন কার পারপাস সার্ভ করার জন্য?
বইয়ে তিনি একটি বারও 'বঙ্গবন্ধু' শব্দ ব্যবহার করেন নি? কেন করেন নি? বঙ্গবন্ধু কি জানতেন না পাকিরা আটার রুটি খায়? এসব লেখার মূল মতলব কি? এই বইয়ে আবু রায়হান নিজেই লিখেছেন, তিনি মুসলিম উম্মাহ ইন আমেরিকা (মুনা)-তে যোগ দিয়ে সদস্য হন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ১৯৯২- ১৯৯৩ বছরগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিশেষ টার্নিং পয়েন্ট। কারণ এই সময়েই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডাকে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি' গঠিত হয়। এই কমিটির যুক্তরাষ্ট্র শাখার যৌথ আহ্বায়ক ছিলেন ড. নুরুন নবী ও কাজী জাকারিয়া। সদস্য সচিব ছিলেন বর্তমান এনআরবি ব্যাংকের কর্ণধার ফরাসত আলী এবং সহকারী সদস্য সচিব ছিলাম আমি।
রায়হান লিখেছেন- সেই ১৯৯২ সালেই তিনি মুসলিম উম্মাহ ইন নর্থ আমেরিকার মেম্বার হন। যে সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তরুণেরা শহীদ জননীর ডাকে ঐক্যবদ্ধ- ঠিক সেই সময়ে রায়হান আলবদর-রাজাকারদের মদত দানকারী সংগঠনের মেম্বার হয়েছিলেন। আমাদের মনে আছে, খন্দকার মোশতাক মারা যায় ৫ মার্চ ১৯৯৬। এর কয়েক মাস পরেই ১২ জুন ১৯৯৬ এর সাধারণ নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগের অবস্থা তখন কেমন ছিল- তা আমরা ভুলে যাইনি। মোশতাককে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সুযোগ আওয়ামী লীগ পায়নি। যদি পেত, তাহলে তার বিচার অবশ্যই করা হতো।
আমি খন্দকার মোশতাককে চিহ্নিত করি বাংলা ইতিহাসের অন্যতম সিরিয়াল কিলার হিসেবে। কারণ ১৫ ই আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে জেল হত্যার মাধ্যমে জাতীয় চার নেতাকে খুন করায় এই খন্দকার মোশতাকই। তা তো আমাদের দেখা ঘটনা। তাহলে এই মোশতাক একজন 'স্নেহশীল' মানুষ হয় কি করে আবু রায়হানের ভাষ্যে? আল আমিন বাবুর প্রতিবাদের পর আমি আবু রায়হানের কাছে এসব বিষয় জানতে চেয়েছি। আবু রায়হান তার বক্তব্যে অনড় থেকেছেন। তিনি বলেছেন- তিনি এটি 'স্যাটায়ার গল্প'- লিখেছেন।
বরেণ্য সাংবাদিক কৌশিক আহমেদ ও খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক হাসান ফেরদৌস এই লেখাটি খারিজ করার পরও তিনি কেন বই করলেন, তা আমি জানতে চাইলে আবু রায়হান বলেছেন- এটা তার লেখার স্বাধীনতা। তার স্বাধীনতা তিনি সমুন্নত রাখতে গিয়েই কৌশিক আহমেদ ও হাসান ফেরদৌসের কথা শোনেন'নি। শোনার দরকার মনে করেন নি। এই বিষয়ে আমি কথা বলি বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক- সাংবাদিক হাসান ফেরদৌসের সাথে। তিনি বলেন,'হ্যাঁ-আমি এই লেখাটি নাকচ করেছি। আমি এই বইটিও ছাপতাম না'। খুনি মোশতাক কি করেছে, তা যে কারোই না জানার কথা নয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা একটি গোপন তারবার্তা থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত খুনি চক্রের আশঙ্কা ছিল, খন্দকার মোশতাক আহমদকে হত্যা করা হতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে এর বদলা নিতে জেল হত্যাকাণ্ড ঘটানো হবে। কিন্তু মোশতাক অক্ষত থাকলেও জেলহত্যা ঘটানো হয়।
ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ১০ নভেম্বর ১৯৭৫ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে ওই তথ্য জানিয়েছিলেন। ১৯৭৫ ঢাকা-০৫৪৭০ ক্রমিকের ওই তারবার্তাটি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দলিল থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, ৭ নভেম্বরকে সিপাহি-জনতার বিপ্লব হিসেবে গণ্য করে এর একটি রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারই তা সমর্থন করেননি। বরং তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ বোস্টারকে ব্যাপকভাবে আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ধারণা করা হয়ে থাকে। বোস্টার লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনায় ভারতের হাত থাকার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। খালেদ মোশাররফকে ভারতপন্থী মনে করেই বিদ্রোহী সাধারণ সৈনিকেরা জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকেছিলেন।’
রাষ্ট্রদূত বোস্টার বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। বিশ্ব এ সময় বাংলাদেশ তিনটি সরকারের পালাবদল প্রত্যক্ষ করেছিল। বোস্টারের ভাষায়, এ সরকারগুলো আমেরিকাবিরোধী ছিল না। তারা ছিল না ভারত কিংবা সোভিয়েতপন্থী। বোস্টার লিখেছেন, ‘এক বা একাধিক মেজরের নির্দেশে ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়।’কয়েক বছর আগে একটি সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু বলেছেন, অনেক আগে থেকেই জাতির পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটছিল খন্দকার মোশতাক।
‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা কি ছিল?’—এই মর্মে করা প্রশ্নের জবাবে আমির হোসেন আমু বলেন, খন্দকার মোশতাক কোনো সময়ই অসাম্প্রদায়িক কিংবা প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তারপরও তিনি আওয়ামী লীগের বড় দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় খন্দকার মোশতাক সূক্ষ্ণ কূটচাল চালতে থাকেন। দেশে যখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছিল মোশতাক বলাবলি করতে থাকেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে জীবিত পেতে চাইলে দেশ স্বাধীন হবে না।’আমরা কৌশল করে বলতাম, ‘দুটোই চাই’।
আমির হোসেন আমু বলেন, ষড়যন্ত্রের কারণে সরকারের পরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় মোশতাককে সাসপেন্ড (আন অফিসিয়ালি) করে রাখা হয়। তখন অলিখিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় কাজ করতেন আব্দুস সামাদ আজাদ। ঐ সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা জোরদার করেন মোশতাক। তার এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি প্রমাণিত হয় ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দেশে পরিণত করার এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। আবু রায়হান এই খুনি মোশতাকের 'মানবিক গুণকীর্তন' করে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এটা অমার্জনীয় অপরাধ। তিনি তার সিনিয়র লেখকদ্বয়কে অবজ্ঞা করেছেন। এবং হঠাৎ করে এসে বঙ্গবন্ধুর নাম সম্পৃক্ত বইমেলার আহ্বায়ক হয়েছিলেন। এটা আমাদের সকলের জন্য চরম লজ্জার ও দুর্ভাগ্যের।
মেলা শেষ হয়েছে। ২০২০ মুজিব বর্ষ। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ভোরে মিশুক সেলিমের এক ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা গেছে, বইমেলার কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। কোন কমিটি, কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছে- তা বিস্তারিত তিনি কিছুই জানাননি। এই বইমেলা আমাদেরকে জানিয়েছে, খুনি মোশতাক-প্রেমীদের। এটা একটি বড় বিষয়। কারণ এখনও ঘাপটি মেরে যেসব মোশতাক ছানা,যেসব আওলাদে রাজাকার,যেসব তালিবায়ে রাজাকার আমাদের চারপাশে রয়েছে, ওদের চিনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এখন বুলি পাল্টে অনেকেই বঙ্গবন্ধু প্রেমি সাজতে চাইছে। যাদের অতীত অন্ধকারাচ্ছন্ন। যারা একসময় কীটের ভূমিকায় ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে।
নিউইয়র্ক ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর