অ্যাকশনে শেখ হাসিনা : এরপরে কে?
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত বিস্ফোরক বৈঠকটি আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাসে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। অনেকদিন পর দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন। এই শুদ্ধি অভিযানটি দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। সেই বৈঠকে শেখ হাসিনা সাংগঠনিক স্থবিরতার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের ভর্ৎসনা করেন। ছাত্রলীগের সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীকে ‘মনস্টার’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। এরপর আসে যুবলীগ প্রসঙ্গ। শেখ হাসিনা বলেন, এরা তো শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ।
মজার কথা হলো, শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে সেদিনই যুবলীগ মাসব্যাপী কর্মসূচি শুরু করেছিল। এ প্রসঙ্গ উঠতেই যেন রাগে ফেটে পড়লেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী। তিনি বললেন, ‘চাঁদাবাজির টাকা হালাল করার জন্য আমার নামে মিলাদের কোনো দরকার নেই। আমার বাবার মৃতদেহ ধানমন্ডির বাড়িতে পড়ে ছিল, আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী দেখতেও যায়নি। আমি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিনি। দেশের মানুষের দোয়া আছে আমার সঙ্গে। কোনো মিলাদ আমার দরকার নেই।
যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি করতে গিয়ে বেঁচে গেছে। এখন নাকি আরেকজন তিন গাড়ি ভর্তি অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করে। এসব ক্যাডার বাহিনী পোষা বন্ধ করুন। কোনো অস্ত্রধারী ক্যাডার আমার দরকার নেই। আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে সবার আগে এরাই অস্ত্র নিয়ে পালাবে। দলের কোনো বিপদে এদের পাওয়া যাবে না। আপনারা যারা এগুলো লালন-পালন করেন, এসব বন্ধ করতে হবে। নইলে আমি যেভাবে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দমন করেছি, সেভাবে এগুলোও দমন করব।’
শেখ হাসিনার বার্তা একদম পরিষ্কার। সেই বৈঠকেই শেখ হাসিনা ঢাকায় ছাদ ভাড়া করে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগ আনেন। শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযোগ আনেন। শেখ হাসিনার এই হুঁশিয়ারির পর যুবলীগ আর ক্যাসিনো সিন্ডিকেটেরে বিরুদ্ধে অভিযানটা ছিল সময়ের ব্যাপার। চারদিনের মাথায় শুরু হয় ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান। প্রথম দিনেই অভিযান চালানো হয় চারটি ক্যাসিনোতে। গ্রেপ্তার করা হয় ২০১ জনকে। তবে তোলপাড় সৃষ্টি হয়, যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুইয়ার গ্রেপ্তারে। দুদিন পর গ্রেপ্তার হন যুবলীগের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা জি কে শামীম। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ঢাকার ক্যাসিনো সিন্ডিকেট দুদিনের অভিযানেই তছনছ। এখন প্রশ্ন হলো, ছাত্রলীগ ঘায়েল, যুবলীগ কাবু; এরপরে কে?
আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো সংগঠন। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আজ সাফল্যের শিখরে। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেকে ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ বুঝি আর কোনো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালে। ৭৫ থেকে ৮১- এই ৬ বছর আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তৃণমূলের ত্যাগী
নেতাকর্মীরা। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরও লড়াই অব্যাহত ছিল।
২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। আর এখন তো টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেই ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোথায় এখন? শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ তাদের মনে রাখেনি। ক্ষমতার স্রোতে বহু কচুরিপানা ঢুকে একসময় স্রোতকেই আটকে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের এখন সেই দশা।
ক্ষমতার হালুয়া-রুটির লোভে নানা দলের লোকজন এসে ভিড় করেছে আওয়ামী লীগে। এই নতুনদের ভিড়ে আড়ালে পড়ে গেছে ত্যাগী নেতাকর্মীরা। ক্ষমতালোভীরা যে এসে ভিড় করেছে, এটা সবাই জানে, সবাই চেনে। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অনেকবার এদের বিরুদ্ধে বলেছেন, কিন্তু ব্যবস্থা নেননি। সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও ছাত্রলীগে শিবিরের অনুপ্রবেশের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সবসময়ই বলা হয়, আওয়ামী লীগার আসলে হওয়া যায় না।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটি উক্তি তো ইতিহাস হয়ে গেছে, ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান, আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যদি ব্যথা পায়, আমিও বুকে ব্যথা পাই। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী যদি ব্যথা পায়, আমারও অন্তরে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগই, এটা কোনো দল না, এটা আমার কাছে একটা অনুভূতির নাম।’ কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘কাউয়া, হাইব্রিড’রা বারবার এই অনুভূতিতে আঘাত করেছে। অর্থ আর ক্ষমতার লোভে আসা নব্য আওয়ামী লীগারদের নানা অপকর্মে বদনাম হয়েছে দলের। আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগে শোভন, রাব্বানী. খালেদ, শামীমদের কমতি নেই। শুধু ঢাকায় নয়, গ্রামে-গঞ্জে ছোট বড় অনেক খালেদ-শামীম আছে।
দল ক্ষমতায় থাকলে নেকাকর্মীরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে লাভবান হবে; এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলের মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করাটা অন্যায়, শাস্তিযোগ্য। এখনকার শুদ্ধি অভিযান সেই হাইব্রিড চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। এ অভিযান আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের। অভিযান শুরুর পর দেখা গেল, খালেদ মাহমুদ ভুইয়া একসময় ফ্রিডম পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, আর জি কে শামীম জড়িত ছিল যুবদলের সাথে। এই দুজনের শত কোটি টাকার গল্প শুনে মনে হতে পারে, যুবলীগ বা ছাত্রলীগ করলেই বুঝি অঢেল টাকা। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। ১৫ বছর ধরে এক যুবলীগ নেতাকে চিনি আমি। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে, তখন থেকে তার সাথে যোগাযোগ। অভিযানের সময় কয়েকদিন কথা বলে বুঝলাম, শত কোটির ছিটেফোঁটাও দেখেননি তিনি।
ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার পদচ্যুতি, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেপ্তার, ক্যাসিনো সিন্ডিকেট ধ্বংসের পর সরকারি দলের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। যাদের দুর্বলতা আছে, সবাই ভয়ে চুপসে আছেন। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, এরপর কে? শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, কাউকেই ছাড়া হবে না। গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সদস্যরা দেখা করতে গেলে তিনি তাদের বলেছেন,‘সমাজের অসঙ্গতি দূর করবো, একে একে সব ধরতে হবে। কাজটি অনেক কঠিন, নানা বাধা আসবে। কিন্তু আমি করবোই।’
শেখ হাসিনার এই দৃঢ় প্রত্যয়ই বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ধরার পর নিশ্চয়ই তিনি সব দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপী, শেয়ারবাজারের কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। তাহলেই দূর হবে সমাজের সব অসঙ্গতি।
এইচআর/পিআর