পুঁজিবাজারে শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি
তানভীর আহমেদ
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসময় অতিবাহিত করছে। অতীতের যে কোন সময়ের থেকে খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে বাজার ধসের পর বাজারের যে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমান বাজার তার চেয়েও অনেক খারাপ, অনেক ভয়াবহ।
১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে শেয়ারগুলো ছিল অতি মূল্যায়িত; তাই স্বাভাবিক ভাবেই মূল্য সংশোধন হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজার এতো বেশি ভয়ংকর যে অবমূল্যায়িত শেয়ারগুলো দিন দিন আরও বেশি অবমূল্যায়িত হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোম্পানির শেয়ারগুলো এক অদৃশ্য শক্তির বলে তার অভিহিত মূল্যের নিচে চলে যাচ্ছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বর্তমানে ৩৫৬টি কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ২০০টি কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ড এর দাম বর্তমানে ২৫ টাকা বা তার নিচে রয়েছে। আরও ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে ১০০টির উপর কোম্পানি বর্তমানে ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে।
গত এক বছরে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৪টি কোম্পানি। এই ৪টি কোম্পানিই এক বছর অতিবাহিত না হতেই তার কাট-অফ প্রাইজের নিচে চলে গেছে।
১. আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেড
কাট-অফ প্রাইজ ছিল ৪০ টাকা। বর্তমান দাম ২৪ টাকা।
২. এস্কয়ার নিট কম্পোজিট লিমিটেড
কাট-অফ প্রাইজ ছিল ৪৫ টাকা। বর্তমান দাম ৩১ টাকা।
৩. বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড
কাট-অফ প্রাইজ ছিল ৮০ টাকা। বর্তমান দাম ৫৬ টাকা।
৪. রানার অটোমোবাইল লিমিটেড
কাট-অফ প্রাইজ ছিল ৭৫ টাকা। বর্তমান দাম ৭১ টাকা।
এই কোম্পানিগুলোতে যারা প্রাইমারি শেয়ার পেয়েছিল তারাও লোকসানে চলে গেছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসির উচিত হবে কোম্পানিগুলো নিয়ে অধিকতর তদন্ত করা। কেন কোম্পানিগুলোর দাম এক বছর না যেতেই ইস্যু মূল্যে থেকে ৩০% নিচে চলে গেল। প্রয়োজনে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কোম্পানিগুলোকে দিয়ে শেয়ার বাই-ব্যাক করানো যেতে পারে।
বর্তমান পুঁজিবাজারে যেখানে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম তার ইস্যুমূল্যের নিচে বা কাছাকাছি অবস্থান করছে সেখানে কিছু দুর্বল মৌলভিত্তিক স্বল্প মূলধনী কোম্পানি তার ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে অবস্থান করছে, যা বর্তমান পুঁজিবাজারকে ভারসাম্যহীন করে দিয়েছে। ধরুন একজন ব্যবসায়ী ১০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের চিন্তা করলো। সেই ব্যক্তি যদি দেখে এই বাজারে, মুন্নু সিরামিক,মুন্নু জুট স্টাফলার, স্টাইল ক্রাফট, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, ওয়াটা কেমিকেল, জেমিনি সি ফুড, কে এন্ড কিউ মতো বন্ধ অথবা দুর্বল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের লেনদেনের প্রথম স্থানগুলো ধরে রেখেছে। তাহলে ওই ব্যবসায়ী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ তো দূরের কথা, যদি তার বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে কিছু থেকেও থাকে তাও তুলে নেবে।
ভালো ফলনের জন্য ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। ঠিক তেমনি পুঁজিবাজার ভালো করতে বাজারের আগাছাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। পাঁচ বছর থেকে ডিভিডেন্ড দেয় না অথবা দীর্ঘদিন থেকে উৎপাদন বন্ধ এমন কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করতে হবে। পাশাপাশি ওই সব কোম্পানির ডিরেক্টরদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা নিশ্চিত যে পুঁজিবাজার ভালো করতে হলে ভালো কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বল কোম্পানি দিয়ে বাজার নষ্ট করা যায়, ভালো করা যায় না।
মুন্নু সিরামিক, মুন্নু জুট স্টাফেলার্স নিয়ে কারসাজির জন্য দ্বিতীয় বারের মতো শাস্তির আওতায় আসছে কিছু অসাধু ব্যক্তি। এর অর্থ আগের শাস্তি যথার্থ ছিল না। প্রথম বারই যদি কঠিন শাস্তি দেয়া যেত তাহলে দ্বিতীয় বার আবার শস্তির আওতায় আনার দরকার হতো না।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই দুরবস্থার অন্যতম আরও একটি কারণ হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্নীতি। তাই ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি পেলে কঠিন শাস্তি প্রদান করতে হবে, যা দেখার পর অন্যরাও যেন সতর্ক হন। প্রয়োজনে ব্রোকারেজ হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ব্ল্যাক লিস্ট করে দিতে হবে। যাতে ওই ব্যক্তি ভবিষ্যতে যেন কোনো ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আর চাকরি করার সুযোগ না পায়।
পুঁজিবাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি। একটি কথা হয়তো আমরা ভুলে গেছি, রাজার ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায় যদি তা লুটপাট হয়। তাই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সুশাসন ফিরিয়ে না আনলে এই বাজার সহজে ভালো হবে না। সব চেষ্টাই একটার পর একটা ব্যর্থ হবে।
এইচআর/জেআইএম