ব্রিটেনের মতো জেগে ওঠো বাঙালি নারী
দেশের বাইরে আসার পর সবচেয়ে নিয়ম করে প্রতিদিন যেটি করা হয় সেটি হলো বাংলাদেশের প্রথম সারির সব পত্রিকায় একবার হলেও চোখ বুলানো। অনেক আশাব্যঞ্জক খবর দেখে যেভাবে খুশি হই, সেভাবেই হতাশ হই প্রতিদিন ছাপা হওয়া ধর্ষণের খবর দেখে। যখন থেকে পত্রিকা পড়ি তখন থেকেই এই নিজউগুলো দেখছি। এর কোন পরিবর্তন নেই। পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু মানুষের অসভ্যতা শেষ হচ্ছে না। তবে ইদানিং মনে হচ্ছে এই ধরনের ঘটনা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। তাই প্রতিদিনই যেন নতুন নতুন নির্যাতনের ঘটনা আমাদের মনকে ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নারী হিসেবে সব সময়ই নিজেকে অসহায় মনে হয়। তা দেশে হোক কিংবা দেশের বাইরে হোক। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে সম্প্রতি অনেকটা কৌতূহল বশেই ইন্টারনেটে খুঁজলাম ব্রিটেনে সব শেষ ধর্ষণের ঘটনা কবে ঘটেছে। কিংবা কোথায় ঘটেছে। বাংলাদেশের মতো ব্রিটেনের ১৫ দিনের পত্রিকা খুঁজে এমন কোন তথ্য পেলাম না, ধর্ষণ বিষয়ক। তবে একটি তথ্য পেলাম ওদের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবসাইটে। তাতে যা দেখলাম ব্রিটেনের নারী নির্যাতনের অভিযোগের ঘটনা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। যা দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হলাম। তার মানে এখানে নারীরা আরও অনিরাপদ।
অভিযোগগুলোর প্রেক্ষিতে লন্ডনের দ্যা মর্নিং ও গার্ডিয়ান পত্রিকার কয়েকটি ফিচারে বলা হয়েছে, রেইপ ক্রাইসিস সেন্টার ২০১৭-২০১৮ সালে ১ লাখ ৭৯ হাজার ফোন কল পেয়েছে ভিকটিমদের কাছ থেকে যারা তাদের কাছে মানসিক সহায়তা চেয়েছে। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ এথনিক মাইনোরিটি মহিলা। আর এইসব নারীদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত সরকারী ১৭ টি সংস্থা। একই সাথে এইসব সংস্থায়ই নারীরা তাদের অভিযোগ দাখিল করেন। তাছাড়া ব্রিটেনে নারীদের সহায়তা প্রদানে তাদের পাশে রয়েছে বেশ কিছু এনজিও।
ব্রিটেনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭-২০১৮ সালে বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ সেশন তারা করেছে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নে শিকার হওয়াদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে মানসিকভাবে বের করে নিয়ে এসে তাদের সুস্থ করার জন্য।
সংস্থাটি আরো জানিয়েছ, ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের ঘটনার শিকার ৩ হাজার ২ শত ৩৬ জনের বয়স ছিলো ১৫ বা তার নিচে। যা ২০১৬-২০১৭ সালের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। ২৯ শতাংশ সহায়তা চাওয়া মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী রয়েছে তাদের তালিকায়।
উপরের এই তথ্য দেখে মনে করার কিছু নেই যে এই সব দেশে ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দেশের তুলনায় বেশি। তবে এখানকার নারীরা অনেক বেশি সচেতন আমাদের দেশের তুলনায়। তাই তারা অভিযোগ করে। এতো অভিযোগ সম্পর্কে কথা হয় কয়েকজন এনজিও কর্মী ও সরকারী সংস্থাগুলোর সাথে। তারা জানায়, নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া শারীরিক সম্পর্কই ধর্ষণ। তা তার স্বামীর সাথে হোক কিংবা তার ছেলে বন্ধুর সাথে হোক। অনেক নারীরা এখানে তাদের স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
তাছাড়া ১৫ বছরের নিচের মেয়ে শিশুরাও তাদের নিকটতম আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। বাংলাদেশে মোটা দাগে নারী নির্যাতন বা যৌন হয়রানী বলতে শুধু রেইপ বা ধর্ষণকেই বুঝায়। আর এখানে একজন নারী যদি কর্মক্ষেত্রে বা রাস্তায় কোন বাজে যৌন বিষয়ক মন্তব্যের জন্য বিরক্ত হয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় সেটাকেই আমলে নিয়ে অভিযোগ করা যায়, সহায়তা পাওয়া যায়।
এই অভিযোগ থেকে শুরু করে সহায়তার পুরো বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে করা হয়। আর আমাদের দেশে নারীদের নিরাপত্তা কই! এক্সট্রিম লেভেলে নির্যাতন হওয়ার পরও যেভাবে তাকে হেনস্থা করা হয়, আমাদের গণমাধ্যম যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করে তাতে একটি মেয়েকে একবার ধর্ষণ হওয়ার যন্ত্রনার চেয়ে সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন! আশে পাশের মানুষের কাছে চিহ্নিত হতে হয় বাজে মানুষ হিসেবে! আর বিচারের বিষয়তো আরো ভয়াবহ!
সাম্প্রতিক সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু বিতর্কিত ঘটনা নারী নির্যাতনের শিকার হওয়া বা না হওয়া নারীদের আরো নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশে সময়োপযোগী অনেক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, এখনই উচিত নারী নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারী উদ্যোগ নেয়ার, আরো অনেক বেশি সেল গঠন করা। সময় এসেছে নারী নির্যাতন বলতে শুধু ধর্ষণ নয়, একটি তীর্যক মন্তব্যকেও আমলে নেয়ার।
লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর