শোভন-রাব্বানীতেই শেষ হোক ছাত্রলীগের অশোভন কাজ
একেই হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে। গত ১২ বছরে ছাত্রলীগের পাপের পেয়ালা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সবসময়ই বলা হয়, সীমা লঙ্ঘন না করতে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে নাকি আল্লাহও পছন্দ করেন না। ছাত্রলীগের নেতারা সত্যিই সীমা লঙ্ঘন করেছেন।
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে মোটা অংকের চাঁদা চেয়েছেন এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। এটি নিছক অভিযোগ নয়। ছাত্রলীগের পদচ্যুত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে ‘ন্যায্য পাওনা’ চাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে গোলাম রাব্বানী জাবি উপাচার্যের সাথে অসমীচীন আচরণের কথা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কিন্তু কখনো কখনো কিছু কিছু অপরাধ ক্ষমার ঊর্ধ্বে উঠে যায়। তাই ক্ষমা পাননি শোভন-রাব্বানী।
অনেকদিন ধরে একটি সিন্ডিকেট ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতো। গত সম্মেলনে সেই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে নিজের পছন্দে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন শেখ হাসিনা। তাই এই কমিটির কাছে তার প্রত্যাশা ছিল বেশি, তাই ক্ষোভটাও হয়েছে বেশি। অবশ্য সম্মেলনের এক বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর থেকেই বিতর্কে জড়ায় ছাত্রলীগের পদচ্যুত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
পদবঞ্চিত নেতারা আন্দোলন, বিক্ষোভ, অনশন করে। তাদের অভিযোগ অর্থের বিনিময়ে অছাত্র, বিবাহিত, অনুপ্রবেশকারী, মাদকাসক্তদের কমিটিতে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। তারা এ ধরনের নেতাদের তালিকাও দেন। আওয়ামী লীগ নেতারাও বিক্ষুব্ধদের সাথে কথা বলেন। আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে কমিটি পুনর্গঠনের অঙ্গীকার করা হলেও তা আর পূরণ করা হয়নি। এখনও ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের হাহাকার ভেসে বেড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তাই তো শোভন-রাব্বানীর পদচ্যুতির খবরে ক্যাম্পাসে উল্লাস করে বঞ্চিতরা। তবে যত দিন যাচ্ছিল, ততই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ, শেখ হাসিনা যাদেরকে অভিহিত করেছেন ‘মনস্টার’ হিসেবে।
অর্থের বিনিময়ে কমিটি দেয়া, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মাদক পাওয়া, দুপুর পর্যন্ত ঘুমানো এসব অভিযোগও যায় শেখ হাসিনার কানে। সিনিয়র নেতাদের দাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠানে দেরি করে যাওয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগই শেখ হাসিনাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে শেখ হাসিনা প্রথম ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভের কথা বলেন। সে বৈঠকে আরো অনেক নেতা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তখন থেকেই আসলে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের পতনের ক্ষণগণনা শুরু হয়। দুদিন চেষ্টা করেও শেখ হাসিনার দেখা পাননি শোভন-রাব্বানী। এরপর তাদের গণভবনের পাস বাতিল করা হয়। আর তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়।
প্রথমে কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরে সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং যুগ্ম সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। চাঁদাবাজির অভিযোগে শীর্ষ দুই নেতার অপসারণের ঘটনা ছাত্রলীগের ইতিহাসে এই প্রথম। ছাত্রলীগের জন্ম আওয়ামী লীগের আগে। আর দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। কিন্তু গত এক যুগে মূল দল ক্ষমতায় থাকায় নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নানা অপকর্মে বারবার দল এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।
যে অভিযোগে শোভন-রাব্বানীকে বহিষ্কার করা হয়েছে; ছাত্রলীগের জন্য তা নতুন নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, ধর্ষণ, দখল- হেন কোনো অপরাধ নেই; যা ছাত্রলীগ করেনি। গত অনেকদিন ধরেই ছাত্রলীগ নেতাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ছাত্রলীগের আগের কমিটির সভাপতি হেলিকপ্টারে করে এক জেলার সম্মেলনে গিয়েছিলেন। আগের কমিটির নেতাদের ব্যয় ও বিলাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ছাত্রলীগের নেতারাই। এমনিতে সংগঠন চালানো এবং নিজেদের ব্যয়ের জন্য সংগঠন থেকেই তাদের টাকা দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও তারা জড়িয়ে পড়ে নানান অপকর্মে।
বিভিন্ন সময়ে এসব অভিযোগের জবাবে ছাত্রলীগের নেতারা দাবি করেন, দলের সিনিয়র নেতাদের নির্দেশেই বাধ্য হয়ে তাদের নানান অপকর্মে জড়াতে হয়। নেতাদের লাঠিয়াল হতে গিয়ে ছাত্রলীগকে অনেক বদনাম নিতে হয়। তবে শুধু ছাত্রলীগ নয়; আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নানাভাবে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়েছে।
শনিবারের সভায় শেখ হাসিনা যুবলীগের চাঁদাবাজির বিপক্ষেও কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেতে আর্থিক লেনদেনের কথাও সবাই জানেন। মনোনয়ন পেতে ছোট নেতাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন বড় নেতারা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের জেলা পর্যায়ের কমিটি করতেও আর্থিক লেনদেন হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপ-কমিটির সদস্য হতেও নাকি টাকা লাগে। শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়, আমাকে ছাড়া।
আসলে গত এক যুগে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের চরম নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। সংগঠন বাঁচাতে বড়সড় শুদ্ধি অভিযানের কোনো বিকল্প নেই। শোভন-রাব্বানীকে অপসারণ করে শেখ হাসিনা সেই কঠিন বার্তাটাই দিলেন সবাইকে। বুঝিয়ে দিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সত্যি সত্যি ‘জিরো টলারেন্স’দেখান। শোভন-রাব্বানীর ঘটনায় যদি বাকি সবাই শিক্ষা নিয়ে নেন, তাহলে তো ভালোই। নইলে হয়তো ভবিষ্যতে আরো বড় কোনো অভিযানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছেন। আশা করি শোভন-রাব্বানীর এই ঘটনাতেই আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সকল অশোভন কাজের সমাপ্তি ঘটবে। তাহলে দেশ ও জাতির সবার জন্যই মঙ্গল।
এইচআর/পিআর