নারী-শাড়ি; এক মোহনীয় মোহনা
“বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা”
কম-বেশি সবার জানা সুবোধ সরকারের ‘শাড়ি’ কবিতারটির পঙক্তিদ্বয়। নতুন বউটি ভাবছিলো ‘এত শাড়ি এক জীবনে সে কীভাবে পরে শেষ করবে?’ বাস্তবতার নিরিখে বছর যেতে না যেতেই রাজনীতির মারপ্যাঁচে স্বামীকে খুন হতে দেখলো চোখের সামনে, এতো শাড়ি থাকতেও তার পরনে উঠে এলো শুধুই সাদা থান। এর পরের ঘটনা আরো বাস্তব। “সেই থানও একদিন এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন/ পাড়ার মোড়ে/ একটি নগ্ন সদ্য বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘বাঁচাও’/ পেছনে তিনজন/ সে কি উল্লাস/ নির্বাক পাড়ার লোকেরা।”
কি বুঝলেন? নিশ্চয়ই বলছেন, এটা কি আমাদের চিত্র, নাকি অন্য কোনো বঙ্গের? আরে ভাই যে বঙ্গেরই হোক, ঘটনা তো ঘটছেই। যদিও উল্লিখিত কবিতার ঘটনাটির জন্য আমি 'শাড়ি'কে দায়ী করছি না। বরং আমার প্রিয় পোশাক 'শাড়ি' নিয়ে আরো একটু ভাবনার খোরাক পেলাম।
সম্প্রতি বেশ কয়েক দিন ধরে শাড়ি নিয়ে একটি লেখাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলে তুমুল ঝড়। লেখক শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মতো এতো বড় মাপের একজন মানুষ কেন 'শাড়ি' প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে নারীকে পণ্যের মতো উপস্থাপন করলেন, কেন তাকে ফিতা দিয়ে মেপে নেয়ার মতো করে নারী দেহসৌষ্ঠবের বর্ণনা দিতে হলো ইত্যাদি নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলেন তিনি।
আমারও কিছু প্রশ্ন আসে এ প্রসঙ্গে। প্রথমত. নারীর জন্য শাড়ি, নাকি শাড়ির জন্য নারী? নাকি পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্যই শাড়ি? অথবা শাড়ি যে নারীর অন্যতম পোশাক তা বুঝাতে কেন লেখকের এমন বর্ণনা। কেন দিতে হবে দৈহিক গড়নের বর্ণনা। শাড়ি নিয়ে কি লেখক কোন সাহিত্য রচনা করতে চেয়েছেন? লেখক কি পারতেন না শাড়ির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে নারীদের প্রীতি বৃদ্ধি করতে?
এখানে একটু বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, মূলত শাড়ি নারীরই পোশাক। এটি বাঙালিদের এমন একটি পোশাক যা পরলে যেকোনো বাঙালি নারীকেই অনিন্দ্য সুন্দর লাগে বলেই বোধ করি। হোক সে খাটো কিংবা লম্বা, চিকন কিংবা মোটা। হ্যাঁ, তবে সৌন্দর্যের তো শেষ নেই, অনেকটা আপেক্ষিকও। আমার কাছে যেটা সুন্দর, অন্যের কাছে সেটা না-ও হতে পারে।
তারপরও আমি বলতে চাই, শাড়ি কিন্তু নারীর জন্যই। আর শাড়ি পরলে নারীর সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই আমি স্যারের শাড়ি লেখাটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম বেশ কয়েকবার। আসলেই স্যারের লেখনীর বিচার করা আমাদের মতো নস্যিদের ধৃষ্টতাই। তবে যেকোনো লেখারই সমালোচনা তো করাই যায়। তার লেখার মধ্যেও কোন কোন অংশের ওপর ব্যাপক সমালোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অথবা তিনি রেখেছেন। হতে পারে অসচেতনভাবেই তার লেখায় ওই অংশটুকু চলে এসেছে।
এতটুকু পড়ে আবার আমাকে কেউ নারীবাদী বলে বসবেন না যেন। কারণ আমি নারীবাদী নই, নারীবাদী শব্দটাও আমার পছন্দের নয়। আমি শুধুই নারী, জন্মগতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন একটি সত্তা, একজন মানুষ। এটা চিরন্তণ বলেই বিশ্বাস করি। বাঙালি চেতনা ও গড়নে শাড়ি আমার অন্যতম পছন্দের একটি পোশাক। দেশে-বিদেশে যত ধরনের বুনন ও সুতার শাড়ি হয় সবই আমি পছন্দ করি এবং পরিধানও করি। শাড়িতে নারীকে অপরূপা দেখায় এটা যেমন আমার কাছে সার্বজনীন মনে হয়, তেমনি দেখতে ভালোও লাগে।
এখন কেউ যদি মনে করেন, আধুনিক নারীরা এখন শাড়িকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়ে পাশ্চাত্যের প্রভাবে স্কার্ট, টপস্, জিন্স, শার্ট ইত্যাদি পরিধানে বেশি আগ্রহী, তাহলে ভুল করবেন। পোশাক মূলতঃ লজ্জা নিবারণের জন্য। তারপর আসে নান্দনিকতার প্রশ্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই যেখানে নারীকে প্রতিটি মুহূর্ত ছুটতে হচ্ছে, সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ অবশ্যই একটি বড় ব্যাপার। তবে এ নয় যে, বাঙালি নারীরা শাড়ি পরে দ্রুত দৌড়াতে পারে না। অবশ্যই পারে, কারণ যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।
ব্যক্তি আমি কিন্তু শাড়ি পরে গাছে চড়েছি, ফিল্ড রিপোর্টিংও করেছি (যদিও সেগুলো এখন নিকট অতীত)। এখনও উৎসব-পার্বণের ভিড়ে শাড়ি পরিহিতা নারীরা সংবাদ সংগ্রহ করেন, পিটিসিও দেন, দাঁড়ান লাইভেও। শুধু আমি বা আমরাই নই, অনেক কর্পোরেট অফিসের ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তাকে দেখেছি যারা নিয়মিত শাড়ি পরেন, এমনকি কাতান শাড়ি পরেও অফিস গাড়ি কিংবা সিএনজি অটোতে চড়ে অফিসিয়াল কাজ অনেক পুরুষের চেয়ে দ্রুত সেরে নেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক নারীরই নিত্যসঙ্গী শাড়ি। তারা কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত শাড়ি পরেন, আনুষঙ্গিক সাজগোজও করেন। তাদেরও চলাচলে কোনো ধরনের অসুবিধা হয় বলে তেমন একটা শুনিনি। নিম্নবিত্ত নারীদেরও শাড়িতে আপত্তি নেই বললেই চলে।
তবে কাজের ধরন, যাতায়াতের দূরত্ব, সব মিলিয়ে পোশাক নির্বাচন করাও আধুনিকতার মধ্যেই পড়ে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ শাড়ির পাশাপাশি অনেক বৈচিত্র্যময় পোশাককে সঙ্গী করলেও শাড়িকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়েছে তা বলাটা অনুচিত ও অযৌক্তিকই বোধ করি।
তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা বলছি না। আমি অনেক নারীকে পেয়েছি, যারা বলেন যে, শাড়ি পরতেই জানেন না। আবার পরতে পারলেও তা বহন করে চলতে পারেন না। কথাগুলো শুনলেই মেজাজ চড়ে সপ্তমে। এ কেমনতর কথা। নারী নাকি পরতে জানে না শাড়ি!! যাহোক, আগেই তো বলেছি এগুলো ব্যতিক্রম।
সর্বজনস্বীকৃত সত্য হলো, শাড়ি নারীরাই পরেন। তাদেরই প্রীতির বহিঃপ্রকাশ এতো এতো নানা বাহারী শাড়ির উৎপাদন। সুতরাং শাড়িকাহন পুরুষ না করে, নারীরই করা উচিত। যেহেতু এই শাড়িতে নারীরই একচ্ছত্র আধিপত্য। আর নারীই জানে এর উপযুক্ত ব্যবহার।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস