ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মূর্তি ভেঙে প্রিয়া সাহাকে মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে কি?

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজা আসছে কী করে জানবেন? পত্রিকার পাতা খুললেই যখন মূর্তি ভাঙার খবরের পরিমাণ বাড়তে দেখবেন, তখনই বুঝতে হবে যে, শারদীয়া দুর্গা পূজা এসে গেছে। এমনিতেই এদিক-সেদিক মূর্তি ভাঙার খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখি কিন্তু এ সময়টায় যেন মূর্তি ভাঙার পরিমাণ লাগামহীন হয়ে ওঠে।

অনেকেই তর্ক করতে চান যে, বাংলাদেশে এখন পূজা মন্ডপের সংখ্যা বেশি বলে ভাঙার পরিমাণও বেশি। কিংবা গণমাধ্যমে এসব খবর এখন বেশি আসছে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব এখন সকলেই তুলে ধরে বলে আমরা জানতে পারি। এই যুক্তি যারা দেন তারা দু’টি বিষয় নিজের অজান্তেই স্বীকার করে নেন, এক) কি অতীত কি বর্তমান, বাংলাদেশে আসলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার জন্য নির্মিত দেব-দেবতার মূর্তি ভাঙা হতো, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে; দুই) এই মূর্তি ভাঙার সংখ্যা আগের চেয়ে আসলে বেড়েইছে, কিছুতেই কমেনি। না কমার কারণ কি? সেটাও আমরা সকলেই জানি, তাই একটু পরে সে কথা নিয়ে আলোচনা করি।

আমরা জানি যে, সংখ্যা যাই-ই হোক না কেন, এদেশ থেকে অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাটা কমছে এবং তা উল্লেখযোগ্য হারেই। এর সঙ্গে আমাদের একথাও স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দেশ থেকে ‘জন’ কমতে না শুরু না করলে এদেশ তাদেরকে ধারণ করতে পারবে না। ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাঙালিই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘মাইগ্র্যান্ট কমিউনিটি’, এবং সেটা বিশ্বময় বিশেষ করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মালয়েশিয়া যারা যান তারা মূলতঃ শ্রমিক হিসেবে গিয়ে আবার ফিরে এসে এদেশে থিতু হন কিংবা সেখান থেকে অন্য দেশে চলে যান। এই যে বাংলাদেশের বাইরে এতো সংখ্যক বাঙালির স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করাটা তা নিয়ে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় কথা তুলে থাকলেও দেশের ভেতর এ বিষয়ে আলোচনা হলেও তার সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসকে কেউ জড়ায় না, বা জড়াতে চান না।

কিন্তু অমুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ ত্যাগ নিয়ে আলোচনায় আমাদের একথাটি সত্যিই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, সংখ্যাগুরুর কোন্ বৈরিতায় একটি জনগোষ্ঠী এদেশ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চায়? কেন তারা ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরী হয়? ভিটেমাটি ছাড়ার অভিজ্ঞতা যাদের নেই, তারা বিষয়টি বুঝবেন না বলেই বিশ্বাস করি। কিন্তু বিদেশে গিয়ে থিতু হওয়া বাঙালি মাত্রেই জানেন যে, আরেকটি সংখ্যাগুরু সমাজে গিয়ে শেকড় ছড়ানোয় কতোটা বন্ধুর ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তাদেরকে যেতে হয়। যদিও ইউরোপ বা আমেরিকার মতো উদার ও বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থায় ‘সংখ্যালঘু’ কিংবা ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ অক্ষুন্ন রেখে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে বেগ পাওয়ার কথা নয় কারোরই, তারপরও আমরা লক্ষ্য করি যে, কোনো কোনো দেশে কট্টরপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসা মাত্র সেখানকার অভিবাসী সম্প্রদায়ের ভেতর হাহাকার ওঠে ভবিষ্যতে সেসব দেশে টিকে থাকা নিয়ে।

ট্রাম্প সরকার যখন আমেরিকায় বসবাসকারী অভিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর নানাবিধ কঠোর নিয়ম/কানুন চাপিয়ে দিতে শুরু করে বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর তার রক্তচক্ষুর বিস্তার ঘটাতে একাধিক প্রকাশ্য ও গোপন নীতি প্রণয়ন করে তখন গোটা বিশ্বেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। একবার ভাবুনতো, বাংলাদেশের অবস্থাটা? ক’জন বাঙালি আছেন, বাংলাদেশে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে দু’টি কথা বলবেন?

পাকিস্তান আমলের কথা যত কম বলা হবে ততোই উত্তম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কী হওয়ার কথা ছিল? বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলেই স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু শুরুতেই যে ভয়ংকরের দেখা এদেশের অমুসলিম জনগোষ্ঠী পেয়েছিল সে কথা বিস্তারিত বলার সুযোগ এই ছোট্ট লেখায় নেই। কিন্তু একথা জোর দিয়েই বলতে চাই যে, যে কোটি খানেক শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তার মধ্যে সংখ্যাগুরু ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং তারা ফিরে এসে তাদের বাড়িঘরের দখল না পেয়ে নতুন করে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল।

এদের সংখ্যা কত তা নিয়ে আমরা বিস্তর আলোচনা করতে পারি কিন্তু তাতে সত্যটা বদলাবে না। এমনকি ভারতে আশ্রয় নেয়া এই শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে নিজ নিজ ভিটেতে পুনর্বাসনের জন্য কমিটি করা হয়েছিল তার প্রধান এখনও জীবিত আছেন, তাকে প্রশ্ন করলেও এই সত্য উন্মোচিত হবে যে, আমরা সত্যিকার অর্থে সকল শরণার্থীকে ফিরিয়ে এনে তাদের ভিটেমাটিতে বসতি গড়ার সুযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছি। তারপর এদেশের মাটিতে অনেক রক্তকান্ড হয়েছে, অনেক জমিজমা দখলের ইতিহাস সৃষ্টি করেছি আমরা। এমনকি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিজয়ী হয়ে আমরা এদেশে হিন্দুদের ভিটেছাড়া করার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীদের মতো হিন্দু নারীকে গণিমতের মাল হিসেবে ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুরতাও দেখিয়েছি।

রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে সংযুক্ত করলে যে বাকি ধর্মবিশ্বাসীরা আক্ষরিক অর্থেই দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যায়, আমরা সেই সত্যটা উপলব্ধিতেও নারাজ। আমরা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে বুক ফুলিয়ে চলতে চাই কিন্তু সরকার বদল হলে প্রথমেই আমরা আঘাত হানা শুরু করি অমুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর। আওয়ামী লীগকে আমরা দায়ী করি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার জন্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় সরকারি চাকুরিতে অমুসলিমদের নিয়োগের কারণে। তাদের দাবি এটাই যে, কেন এতো অমুসলিমকে সরকারি চাকুরি দেয়া হচ্ছে।

কেউ কেউ একটু এগিয়ে গিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’কে এর জন্য দায়ী করেন এবং যেহেতু শেখ হাসিনার সরকার তাদের মতে ভারতের তাঁবেদার সরকার সেহেতু ভারতের নির্দেশেই শেখ হাসিনা এতো সংখ্যক অমুসলিমকে সরকারি চাকুরি দিয়েছেন এবং তারা যথারীতি এদেশে কামিয়ে ভারতের ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন বলে এই শ্রেণিটি মনে করেন। যদিও সম্প্রতি আসামে যে বিশাল অ-ভারতীয় নাগরিকের তালিকা হয়েছে সেখানে মুসলমানের তুলনায় হিন্দুর সংখ্যাধিক্য হওয়ার পর এরা কী বলবেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।

শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম, এই যে দুর্গা পূজা আসলেই দিকে দিকে মূর্তি ভাঙার হিড়িক পড়ে এর পেছনে আসলে কোন্ মনঃস্তত্ত্ব কাজ করে? মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো বিষয়টি ভালো বলতে পারবেন কিন্তু আমার মনে হয় এটা এক ধরনের উৎসব মূর্তি ভাঙার, এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে এটা দেখিয়ে যে, চাইলেই হিন্দুদের প্রতিমা ভেঙে এই ধর্মটাকে অসার প্রমাণের, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরও করা যায়। কিন্তু এই তলোয়ারধারীদের এই সত্য জানা নেই যে, দেবতার পূজো শেষ হলে তাদেরকে বিসর্জন দেয়া হয়, তাদেরকে এই পৃথিবীতে রেখে দেওয়ার নিয়ম নেই, তাই মূর্তি ভাঙলেই কোনো ধর্মকে অসার প্রমাণ বা খাটো করা যায় না। অশিক্ষিতের অহং ভয়ঙ্কর বার বার এদেশে সেটা প্রমাণিত হয় কিন্তু রাষ্ট্র এখানে সব সময়ই নীরবতা বজায় রাখে এবং আজ পর্যন্ত মূর্তি ভাঙার দায়ে কাউকে তার প্রাপ্য শাস্তি দেওয়ার নজির এই রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করতে পারেনি কিন্তু বুক ফুলিয়ে অসাম্প্রদায়িক, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা দেওয়ার উদাহরণ সৃষ্টিকারী কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকতে কোনো ভাবেই রাজি নয়।

সম্প্রতি প্রিয়া সাহা নামে একজন অ্যাক্টিভিস্ট আমেরিকায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের রক্ষার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। দিকে দিকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে, তাকে আমরা একপ্রকার বাংলাদেশের বাইরে ঠেলে দিয়েছি। তিনি অসত্য বলেছেন একথা প্রমাণের জন্য আমরা সকলেই বহুবিধ প্রমাণাদি হাজির করে তাকে যারপর নাই অপমান/অপদস্থ করেছি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও এনেছি, আবার গিলেওছি সে অভিযোগ। কিন্তু এই যে চারদিক থেকে প্রতিদিন মূর্তি ভাঙার খবর আসছে তাতে প্রিয়া সাহার বক্তব্যই কি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন কি আমরা নিজেদেরকে একবারও করেছি?

করিনি বা করার প্রয়োজনও বোধ করছি না। প্রিয়া সাহাকে মিথ্যা প্রমাণের দায়িত্ব যেমন আপনার বা আমার সকলের তেমনই প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে সত্য প্রমাণে এই দিকে দিকে মূর্তি ভাঙার মচ্ছবও এক অকাট্য ‘এভিডেন্স’ পারবেন এর পাল্টা ‘এভিডেন্স’ দিতে?
পূজা আসছে, সবাইকে আগাম শারদ-শুভেচ্ছা।

ঢাকা ১০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৯

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন