ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জি-সেভেন সম্মেলন ব্যর্থ

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংস্থা গ্রুপ অব সেভেন বা জি-সেভেনের ৪৫তম সম্মেলন এবার অনুষ্ঠিত হলো ফ্রান্সের বিয়ারিতজ শহরে। গত ২৪, ২৫ ও ২৬ আগস্ট সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। জি-সেভেনের সদস্য রাষ্ট্র হচ্ছে কানাডা, জাপান, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে রাশিয়াও এই জোটে ছিল বলে একে জি-এইট নামেও ডাকা হতো। কিন্তু ক্রিমিয়া দখল করার পর রাশিয়াকে বের করে দেয়া হয় সংস্থা থেকে। রাশিয়া ও চীন এই সংস্থার সদস্য হলে সংস্থাটি পূর্ণাঙ্গতা পেত।

এবারের সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়াকে আবারও সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যদিও কেউই ট্রাম্পের প্রস্তাবে সম্মত হননি। ট্রাম্পের দাবির জোরালো বিরোধিতা করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক। অবশ্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন- তারা এই সংস্থায় পুনরায় যেতে আগ্রহী নন। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী এই সাতটি দেশ বিশ্বের ৫৮ শতাংশ সম্পদের মালিক। তৃতীয় বিশ্ব এটাকে পুঁজিপতিদের ক্লাব হিসেবে বিবেচনা করে।

সাধারণত দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা প্রতি বছর একবার সম্মেলনে মিলিত হয়ে বিশ্বের চলতি সমস্যাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং সম্মেলন শেষে একটা যৌথ বিবৃতির মধ্য দিয়ে তারা তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এবার তারা অনেক বিষয়ে পরস্পর ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বলে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করতে পারেননি। অধিকাংশ এজেন্ডা মার্কিন প্রেসিডেন্ট দ্বিমত পোষণ করায় ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি।

অন্যান্য রাষ্ট্র বেশি বাড়াবাড়ি করলে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। গত বছর কানাডায় যখন ৪৪তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তখন ট্রাম্পের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানের কথা কাটাকাটি হলে ট্রাম্প মাঝপথে সম্মেলনস্থল ত্যাগ করে চলে যান। এমন পরিস্থিতি এড়াতে গিয়ে যৌথ বিবৃতি প্রদান সম্ভব হয়নি।

আমেরিকা এখনও বিশ্বের এক নম্বর সুপারপাওয়ার আর তার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ট্রাম্প। গত তিন বছর ক্ষমতাসীন অবস্থায় তার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি একাই বিশ্বব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। জাতিসংঘের ২৪ শতাংশ খরচ এতদিন আমেরিকা সরবরাহ করত। ট্রাম্প যেভাবে তা কাটছাঁট করছেন তাতে মনে হচ্ছে হয়তো বা জাতিসংঘ সামনে আর্থিক অনটনে পড়বে। আমেরিকা নিজেই যথেষ্ট আর্থিক সংকটে আছে। সুতরাং তার ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপ নিতেই হবে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যসব শক্তিকে এগিয়ে এসে জাতিসংঘকে রক্ষা করতে হবে।

কিন্তু তেমন উদ্যোগ নিতে একক বা সম্মিলিতভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। এটি বিশ্বব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই সম্মেলনের বিরুদ্ধে দুখী মানুষের বিক্ষোভ প্রতিবাদ প্রতিবারই অনুষ্ঠিত হয়। ইতালিতে ২০০১ সালের সম্মেলনে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিন শতাধিক ব্যক্তিকে নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেকে আহত হন। পুলিশের গুলিতে ২৩ বছর বয়সী অ্যাক্টিভিস্ট কার্লও জুলিয়ানি নিহত হন। এরপর থেকে এই সম্মেলন কোলাহলময় কোনো শহরে আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

জি-সেভেন বিত্তশালী দেশগুলোকে নিয়ে শুধু চিন্তা করছে তা নয় গরিব রাষ্ট্রগুলোর প্রতিও তারা সময়ে সময়ে নজর দিয়েছে। ১৯৯৯ সালের জি-সেভেন সম্মেলনে গরিব রাষ্ট্রগুলোর ঋণ মওকুফ করে দিয়েছিল ৯০ শতাংশ। যার পরিমাণ একশ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৬ সাল থেকে জি-সেভেন সম্মেলনে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করা শুরু করেছে। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার ফলে এখন জি-সেভেন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে উদ্যোগী হচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে সচল রাখছে এবং স্থবিরতা থেকে রক্ষা করছে।

এবার ফ্রান্সে ৪৫তম জি-সেভেন সম্মেলন ফলশূন্য অবস্থায় শেষ হয়েছে। এটি বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ইঙ্গিতবহ। এই সম্মেলনে ব্রাজিলের আমাজান জঙ্গলে আগুন, ইরান-আমেরিকা দ্বন্দ্ব, হংকংয়ের আন্দোলন- এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে সত্য কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ গৃহীত হয়নি। সারাবিশ্ব এখন পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাজান পুড়ছে সম্মেলনের সময়ও। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই বনটি পরিচিত পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে। কারণ সারাবিশ্বে যে পরিমাণ অক্সিজেন তৈরি হয় তার ২০ শতাংশ আসে এই আমাজন থেকে। কিন্তু আমাজানের আগুন নেভানোর জন্য যে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে তাও পর্যাপ্ত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়েও উল্লেখযোগ্য কথাবার্তা নেই।

কানাডায় অনুষ্ঠিত ৪৪তম সম্মেলনের পর গত বছর প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর পক্ষ থেকে চার হাজার শব্দের যুক্ত ঘোষণা প্রকাশ করা হয়েছিল। আর ওই ঘটনায় সর্বমোট পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যৌথ ইশতেহার স্থান পেয়েছিল। ইশতেহারে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি ছিল। আর এবারের সম্মেলনে মাত্র ২৭৬ শব্দের একটি ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে যেখানে উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় স্থান পায়নি। অর্থমন্ত্রীদের বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি তাদের পর্যবেক্ষণ বাড়ানোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে সত্য কিন্তু সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অবস্থার মন্দাভাব কাটানোর কোনো প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ নেই।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ হঠাৎ করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সম্মেলনে ডেকে নিয়েছিলেন। কিন্তু সম্মেলনে ইরান সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য কিছু আলোচনা হয়নি। কোনো সমাধানের দিকনির্দেশনাও স্থির হয়নি। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠক করতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রহ প্রবল। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট রুহানির সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছিলেন কিন্তু রুহানি বলেছেন অবরোধ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন না। হংকং, লিবিয়া সম্পর্কেও কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।

বিশ্বে বহু দেশ। সুতরাং বিরোধ থাকবেই। বিরোধের মধ্যে বিতর্কের সমাপ্তি ঘটানো যাবে না। এতদিন পর্যন্ত বিশ্বে আমেরিকাই ছিল একমাত্র দেশ যার বিশ্বব্যবস্থাকে বিন্যাস করার মতো শক্তি ছিল। অন্য কোনো দেশ নেই যার এমন কোনো ক্ষমতা আছে। ট্রাম্পের সময় আমেরিকা সেই ক্ষমতা ব্যবহারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। সুতরাং নেতৃত্বহীন হলেই বিশ্বব্যবস্থা ধস নামবে। সর্বতোভাবে অনিরাপদ করে তুলবে। এবার জি-সেভেন সম্মেলনে তাই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/জেআইএম

আরও পড়ুন