ভয় ছড়িয়ে অভয়ের নিষ্ঠুরতা
সত্যিই হামলার টার্গেটে পড়তে যাচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা? শঙ্কাটির কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর সাম্প্রতিক হামলাকে বড় হামলার প্রস্তুতি অ্যাসিড টেস্ট বলেছেন তিনি। কী বা কোন তথ্যের আলোকে এমন বার্তা দিলেন ক্ষমতাসীনদলের এই সেকেন্ড ইন কমান্ড?-এ প্রশ্ন তাকে গণমাধ্যমকর্মীরা করেননি। তার এই বার্তাকে মোটেই আর আট-দশটা মেঠো বক্তৃতা বা বচনের মতো নেয়া যায় না। কারণ, বিষয়টা ঠুনকো নয়। বাতকে বাত হতে পারে না।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শনিবার রাতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাকে ঘিরেই ওবায়দুল কাদেরের এসব মন্তব্য বা শঙ্কা। ওই হামলায় পুলিশের এএসআই শাহাবুদ্দিন ও ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আমিনুল আহত হয়েছেন। শাহাবুদ্দিনের দুই পায়ে স্প্লিন্টারের আঘাত লেগেছে। আর আমিনুল আঘাত পেয়েছেন হাতে।
সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে এসংক্রান্ত একটি বিবৃতিও রয়েছে। কিন্তু তা শুধু সাইটের নিবন্ধিত গ্রাহকের জন্যই উন্মুক্ত। সাইট ইন্টেলিজেন্স এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলাসহ বিভিন্ন হামলার তথ্যের পাশাপাশি আইএসের দায় স্বীকারের তথ্য প্রচার করেছে। বরাবরের মতো এবারও আইএসের দায় স্বীকার সম্পর্কিত আরবি ভাষায় বার্তার ছবি সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এবারের বার্তাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—‘আল্লাহর ইচ্ছায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার সৈনিকরা রাজধানী ঢাকায় (যাদের অনেকে মুরতাদ হয়ে গেছে) হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে। তবে এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি, অতি দ্রুত তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায়।’
আইএসকে পানসে করে ফেলা হয়েছে। গাড়ির চাকা বার্স্ট হলেও আইএসের কাণ্ড বলে চালানোর চেষ্টা চলে। আইএসের মতো দুর্ধর্ষরা ‘পটকা ফোটায়-সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। ২০১৬ সালে রমজান মাসে রাজধানীর হলি আর্টিজানে হামলার আগে নাটোরের মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ হত্যার পরও বলা হয়েছিল সেটি আইএস ঘটিয়েছে।
গত পাঁচ মাসে পুলিশের ওপর বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় সাইট ইন্টেলিজেন্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশকে টার্গেট করেই জঙ্গিরা এসব হাতবোমা হামলা করেছে। আবার পুলিশের দাবিও তা-ই। সায়েন্স ল্যাবে পুলিশের ওপর হামলাকে একটি দুর্ঘটনা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ নিয়ে শঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। ঘটনার পরপরই এর দায় নিয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-আইএস। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম প্রচারকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স এক টুইট বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে। এর উল্টাপিঠেই তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে আইএস নেই।
কী দাঁড়ালো অর্থ? কী বুঝবে মানুষ? এর আগেও কিছু ঘটনায় এমন দায় নেয়ার তথ্য রয়েছে। কিন্তু, এই সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের উৎস কোথায় এবং পরিচালনা কারা করে-সেটা আজতক খোলাসা হয়নি। এমন স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও কোত্থেকে ছাড়া হচ্ছে তা জানা কি অসম্ভব? হাতবোমা না হয়ে শক্তিশালী কোনো বোমা হলে এসব হামলায় পুলিশসহ বহু মানুষ হতাহত হতেন। তা কি জঙ্গিদের দুর্বল হয়ে পড়ার নমুনা? এখন ভারী অস্ত্র বা শক্তিশালী বোমা নেই তাদের কাছে?
একে শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সমস্যা নামে পার করে দেয়ার মানসিকতাও দেখা যাচ্ছে। এর আগে গুলিস্তান, মালিবাগ বা পল্টন-খামারবাড়ী এলাকায় এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত যায়নি। কুলকিনারা আছে কি-না, সেটাও জানানো হয়নি। মাঝেমধ্যে উড়োখবরের মতো শোনানো হচ্ছে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে বসে বাংলাদেশে জঙ্গিপনার ডিরেকশন দেয়ার ভয়ঙ্কর তথ্য। শোনানো হয় নব্য জেএমবি, আল্লাহর দল ইত্যাদি নামও। ক’দিন পর ঘটনা এবং দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সামনে চলে আসে নতুন ঘটনা। তামাদি হয়ে যায় পেছনের সব ঘটনা।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাকে মোটেই স্বাভাবিক বা বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। মাঠ পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টা কাজে থাকে পুলিশ। ঢাকা বা শহরাঞ্চলে দায়িত্বের চাপ কখনো কখনো মাত্রা ছাড়ানো। ঝুঁকিপূর্ণও। কেন পুলিশকে বারবার টার্গেট করা হচ্ছে?- স্পষ্ট জবাব নেই। একদিকে, চলতে থাকে ধারণানির্ভর নানা ব্যাখ্যা। রাজনৈতিক কথামালা। আরেকদিকে বিরতি দিয়ে ক’দিন পর পরই হামলার শিকার হতে থাকে পুলিশ। এর সঙ্গে এখন যোগ হলো ভবিষ্যতে মন্ত্রী-এমপিদের ওপর হামলার শঙ্কা। আবার বলা হচ্ছে, আতঙ্কের কিছু নেই।
এ ধরনের ঘটনায় সুস্থ্-স্বাভাবিক কারো পক্ষে আতঙ্কমুক্ত থাকা কঠিন। মানুষ মারা, মার খাওয়া এখন বড় দাগের ঘটনা হয় না। কিন্তু পুলিশ মার খেতে থাকবে, মন্ত্রী-এমপিদের ওপরও হামলার প্রস্তুতির তথ্যঝড়ে কী শঙ্কামুক্ত থাকা যায়? এসব বিস্ফোরণের রহস্য ও হোতাদের শনাক্ত করা না গেলে সামনে আরো কি-না ঘটতে পারে, সেই ভয় থেকেই যায়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম