ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মোদিজি’র হাতেই বিজেপির ভাঙন লেখা নেই তো?

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ১২:৫৭ পিএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বার বার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যদি পরীক্ষা দিয়ে সেটা টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে সে বন্ধুত্ব ছিন্ন হতে বাধ্য- মনস্তত্ববিদগণ একথাটি জোর দিয়েই বলে থাকেন। বিশেষ করে সম্পর্ক নিয়ে যারা কাজ করে থাকেন তারা মানেন যে, কোনো সম্পর্কই একপাক্ষিক হলে তা ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে দ্বি-পাক্ষিক ও পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর হওয়ার ওপরেও জোর দিয়ে থাকেন।

এই মুহূর্তের পৃথিবীর দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায় যে, পৃথিবী আসলে ভারসাম্যপূর্ণ নয়, বরং সেই শীতলযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহ অবস্থায় না থাকলেও মনে হতে পারে যে, আমরা একটি অঘোষিত যুদ্ধাবস্থাতেই আছি। কখনও এই যুদ্ধকে বলা হচ্ছে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কৌশল, কখনওবা বাণিজ্য সম্প্রসারণের কৌশল কিংবা কখনও বলা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিবেশির সঙ্গে বিরোধ বাঁধানোর কৌশল।

যে কোনো কৌশলই হোক না কেন, পৃথিবীর ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে আমরা এরকম বহুবিধ ও বহুপাক্ষিক যুদ্ধাবস্থার ভেতর দিয়েই দিন পার করছি। ফলে মানুষের ভেতর পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তেমনই দেশে দেশেও এই অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে যে সকল দেশ এতোকাল সুনাম কুড়িয়েছে তারাই এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যাতে মনে হতে পারে যে, গণতন্ত্র বলে আদৌ কখনও কিছু ছিল কি? কিংবা প্রশ্ন উঠছে, গণতন্ত্র বলতে আসলে এখন আমরা কী বুঝছি?

দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বয়স শত শত বছর পেরুনোর পরও যখন এরকম প্রশ্ন নিয়ে ব্যক্তি মানুষের মনেই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে তখন সত্যি সত্যিই সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্র ও তার টিকে থাকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, এ সংশয় নিরসনে কাউকে কোথাও এগিয়ে আসতেও দেখা যাচ্ছে না। এর জন্য কোনো একটি মাত্র পক্ষকে দায়ী করা যাবে না হয়তো, সকলেই কম বেশি দায়ী কিন্তু তাতে এই প্রশ্ন ও সংশয় থেকে আমাদের মুক্তি মেলে না।

উদাহরণ দিতে খুব বেশি দূর যাবো না আমরা। প্রতিবেশি ভারত রাষ্ট্র নিয়েই আজকের দিনের গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক। ভারত উপমহাদেশে গণরাজ্যের ইতিহাস গ্রীকদেরও গণতন্ত্র-চেতনা সৃষ্টিরও আগের বলে দাবি করা পণ্ডিতের অভাব নেই। আধুনিক ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, এই ভারত উপমহাদেশ যুগে যুগে নানা বর্ণ-ধর্ম-জাতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সহাবস্থানের এক নতুন সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। তার কতটা স্বতঃপ্রণোদিত ছিল আর কতটা বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিল তা নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পারে কিন্তু এই সত্যকে কখনওই অবহেলা করা যাবে না যে, ভারত উপমহাদেশ আসলে প্রকৃতভাবেই বহুত্ববাদের উদাহরণ হিসেবে পৃথিবীতে এতোকাল বিরাজমান ছিল।

পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছেন যে, ভারত উপমহাদেশে এই বহুত্ববাদের উদাহরণটি এখানে অতীতকালে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ ভারত উপমহাদেশ আর সেই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক অবস্থানে নেই। বরং ভারত উমহাদেশ গত একশ বছরে যে রক্তপাতের উদাহরণ তৈরি করেছে তা মূলতঃ বহুত্ববাদকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার ইতিহাস। ধর্ম ও জাতীয়তার যে সম্মিলন এই উপমহাদেশে ঘটেছিল তা বহুধা বিভক্ত হয়ে এখন এমনই ক্ষুদ্র ও সহিংসতার জন্ম দিয়েছে যে, পৃথিবীর ইতিহাস যারা পাঠ করেন সেই সব ছাত্রছাত্রীর কাছে এই উপমহাদেশ কখনও কখনও তীব্র ও শ্লেষাত্মক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। ইউরোপে ক্ষমতা দখল ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ইতিহাস সৃষ্টি করলেও আবার তারা উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে এই বহুত্ববাদকে নির্ভর করেই। যদিও ব্রিটিশ গণভোট তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং এই প্রশ্নকেই মূলতঃ মুখ্য করে তুলেছে যে, তাহলে কি মানুষ আসলে একত্রে বসবাস করতে পারে না? অন্য যে কোনো প্রাণীর মতোই মানুষও কি তবে স্বার্থপর ও বিচ্ছিন্ন? তাহলে নিজেকে মানুষ শ্রেষ্ঠ দাবি করে কোন্ বিচারে?

ভারতে ফেরা যাক। এই মুহূর্তের ভারত রাষ্ট্রকে কেউ কোনো ভাবেই বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। যদিও সেখানে গণতন্ত্র আছে, রয়েছে বহুত্ববাদী হওয়ার মতো যথেষ্ট উপকরণ। কিন্তু ভারত তার অতীতকে অস্বীকার করে কেন বর্তমানকে এরকম ভয়ঙ্কর করে তুলছে? কেন ভারতের অন্তর্গত চারিত্রিক বদল ঘটছে সে প্রশ্ন উত্থাপন এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দুত্ববাদ সনাতন কাল থেকেই অন্যায্য উগ্রবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেনি বরং হিন্দুত্ববাদকে মাটির গন্ধ মাখানো জীবনবোধ ও সংস্কৃতি হিসেবে পুস্তকাদিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

মহাভারত কিংবা রামায়ণের মতো মহাকাব্যই যে হিন্দুত্ববাদের শ্রেষ্ঠতর উদাহরণ এবং সেখানে সবকিছু ছাপিয়ে জীবনবোধই যে শিক্ষণীয় সেকথাও অস্বীকার করার জো নেই। এর সঙ্গে বেদ ও বেদান্তকে যুক্ত করে আমরা হিন্দুত্ববাদকে অন্য সকল ধর্মবাদ থেকে আলাদা করতে পারি। এমনকি একথাও জোর দিয়ে বলা যায় যে, হিন্দুত্ববাদ কখনওই কট্টর রাজনৈতিক ‘বাদ’ হিসেবে এই উপমহাদেশে বিরাজমান ছিল না। বরং একটি সংস্কৃতি হিসেবে এই উপমহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং টিকে থেকেছে।

হতে পারে যে, যুগে যুগে তার ওপর আঘাত এসেছে অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির এদেশে এসে শেকড় বিস্তারের ফলে কিন্তু তাতেও যে খুব অসুবিধে হয়েছে তা নয়। বরং হিন্দুত্ববাদের ভেতর ব্রাহ্মণ্যবাদ আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলে তাকে প্রতিহত করতে এর অন্তর্নিহিত শক্তিই অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ‘সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই’ প্রবাদের মতো সময় এতোটাই বদলেছে যে, একটি জনপ্রিয় ও বিপুল ভোটে বিজয়ী রাজনৈতিক দলকেও হিন্দুত্ববাদকে সহিংস ও মানবতা-বিরোধী রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বলাই বাহুল্য যে, মানুষ এখনও এই অপকৌশলকে পছন্দ করছে না। ভারতের অভ্যন্তরেই কাশ্মীর ও আসামে যা ঘটছে কিংবা অচিরেই অন্যান্য রাজ্যে ‘নাগরিক সনাক্তকরণের’ নামে যা ঘটতে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে। খোদ্ বিজেপি’র ভেতরেই আসামের নাগরিক তালিকা নিয়ে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই দলটির বহুধা বিভক্ত হওয়ার যে সম্ভাবনা একেবারেই নেই তা হলপ করে বলা যায় না।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, একটি জনপ্রিয় ও বিপুল ভোটের সরকার ক্ষমতায় এসে ভারতের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোকে কেন বার বার বন্ধুত্বের পরীক্ষায় ফেলছে সেটাও একটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠছে। এভাবে ‘একলা চল’ নীতি ভারতকে মানায় না সেটা যেমন সত্য তেমনই ভারত সেটা কতদিন পর্যন্ত ‘ধারণ’ করতে পারবে সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন। ভারতের চারদিকে তাকালে দেখতে পাই যে, এক সময় ভারতের সঙ্গে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে চমৎকার এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে শুরু থেকেই ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল না, সেটার জন্য পাকিস্তানের দায়-দায়িত্বই বেশি সেটা স্বীকার করতে কারোরই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাকি যে সকল রাষ্ট্রের কথা এখানে বলা হলো তার মধ্যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ছাড়া আর কারো সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আছে বটে কিন্তু সুসম্পর্ক নেই। এর জন্য ‘বড় ভাই রাষ্ট্র’ হিসেবে সকল দায়-ই যে ভারতের তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বহু নির্মোহ গবেষকই একথা বলবেন যে, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার মতো রাষ্ট্র কখনওই ভারতকে বাদ দিয়ে ‘চৈনিক বলয়ে’ ঢুকতে আগ্রহী ছিল না, ভারতের অ-বন্ধুতা কিংবা বার বার বন্ধুত্বের পরীক্ষা দিয়ে সফল হতে না পারার ফলেই তারা আজকে ভারত-ভিন্ন পথ খুঁজছে। এর জন্য ভারতকে কী মূল্য দিতে হচ্ছে তা ভারতের অর্থনীতির সাম্প্রতিক ধসই তা প্রমাণ করে। বাণিজ্যিক ভাবে ভারত যে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ‘পাঙ্গা’ নিতে গিয়ে তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে কাশ্মীর ও আসামের এই কুকর্মের পরে।

‘হারাধনের দশটি ছেলের’ মতো এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বে কেবল বাংলাদেশই নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকে আছে, এর কারণ বহুবিধ ও ঐতিহাসিক। এ নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, যদিও সকলেই আমরা বিষয়টি জানি। কিন্তু আসামের নাগরিক পঞ্জিতে যে ১৯ লাখ মানুষকে ভারতের ‘নাগরিক তালিকা’ থেকে ‘চ্যুত’ করা হয়েছে এবং তাদেরকে যদি আসামের অর্থমন্ত্রী কথিত ‘বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ’ করার পদক্ষেপ ভারতের মোদি-সরকার গ্রহণ করে তাহলে এই বন্ধুত্ব কেবল নষ্টই হবে না, বরং শত্রুতায়ও পর্যবসিত হবেই হবে। চারদিকে এতো শত্রু নিয়ে ভারত উন্নয়ন ও টিকে থাকবে কোন্ শক্তির জোরে?

দুর্মূখেরা অবশ্য বলছেন যে, এসব সবই মার্কিনী-চক্রান্ত, চীনের বিরোধিতায় ভারতকে পাশে রাখতে মার্কিনীরা ভারতকে দিয়ে এসব করাচ্ছে কাছের বন্ধুদের ‘পর’ করে দিয়ে সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারের বন্ধুকে ‘আপন’ করে ভারত তার অখণ্ডতা বজায় রেখে এই প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না। যদিও সেটা অনেক পরের কথা, সবার আগে দেশের ভেতরে এরকম অপকর্মাদি ও একটি নিরীহ সংস্কৃতিকে ধর্মীয় রাজনীতির হাতিয়ার করার ফলে মোদিজি’র হাত ধরে বিজেপি নামক দলটিই ভেঙে যায় কিনা সেটা দেখার অপেক্ষাতেই আজকের মতো আলোচনার ইতি টানছি। কথায় বলে না, অন্যের ক্ষতি করলে নিজের অজান্তেই নিজের ক্ষতিটি ঘটে যায়- ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস কিন্তু সম্মিলনের, বিচ্ছিন্নতার নয়।

ঢাকা ৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৯

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

আরও পড়ুন