ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মুজিব : প্রজন্মের ঋত গৌরব

মিলি সাহা | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১৮ আগস্ট ২০১৯

১৯৯৬ সাল; আমি তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। ৭৫' এর ২০ বছর পর প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কলেজ থেকে ফেরার পথে লাইব্রেরিতে খাতা কিনতে গিয়ে চোখে পড়লো সাদা-কালো একটি পোস্টার সাইজ ছবি; 'বঙ্গবন্ধু' কথাটি কোথাও লেখা ছিল কিনা মনে নেই।

আমি নিশ্চিত, নিচে শেখ মুজিবুর রহমান লেখা না থাকলে ছবিটি আমাকে এতটা উদ্বেলিত করতো না; হয়তো শুধু দেখেই যতটা ভক্তি সঞ্চার হতো মনে মনে তা নিয়েই হোস্টেলে ফিরে যেতাম। যাই হোক, নামটি দেখেই আমার চমকে ওঠার পালা। এই সেই নাম যা শুধু বাবার মুখে শুনে শুনেই বড় হয়েছি; সেই ব্যক্তিত্ব যাতে আমার বাবা-মায়ের অশেষ মুগ্ধতা ছিল; যার গল্প বলার সময় বাবার লুকানো দীর্ঘশ্বাস আমাকে অবাক করতো।

মাই গড, বাবা তো জানেই না তাঁর ছবি এখানে পাওয়া যায়! উনি তো প্রায় নিষিদ্ধ ছিল এদেশে। আর একটুও না ভেবে লাইব্রেরির লোকটিকে বললাম, আমাকে এই ছবি দুটো দিয়ে দিন তো। কি ভেবে লোকটি বলে উঠলো, ওর মনে হচ্ছে রাজনীতিতে অনেক আগ্রহ। আমার আরেকবার অবাক হবার পালা; শেখ মুজিব তো এদেশের স্বাধীনতার নায়ক, এতে রাজনীতির কি হলো? উনি তো শুনেছি জাতির পিতা; আমাদের সবার নেতা। ওনাকে চাইতে কি রাজনীতি করতে হয়? ইন ফ্যাক্ট, রাজনীতি কি সেটাই তো বুঝি না।

আমার তখন এর বেশি ভাবার সময় নেই; ভাবছিলাম কত তাড়াতাড়ি বাবাকে একটা ছবি দিতে পারবো। ওনাকে দেখতে তো ঠিক বিশ্বের বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী ও নেতাদের মতো। তাহলে কি আমাদেরও এরকম একজন ছিল? ফিরে এসে একটি ছবি পড়ার টেবিলের সামনে দেয়ালে লাগিয়ে দিলাম; আরেকটা যত্ন করে ব্যাগে রেখে দিলাম। যতবারই দেখতাম মনে হতো অনেক বড় কোনো কাজ করে ফেলেছি।

সেই থেকে শুরু হলো আমার বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কারের পালা; যেখানে যা-যতটুকু পেতাম, গোগ্রাসে পড়ে ফেলতাম। তখনই যে অনেক রিসোর্স পাওয়া যাচ্ছিলো, তাও নয়। মনে আছে, কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু বিষয়ে একটি রচনা প্রতিযোগিতায় নাম দেয়ার পর বাবা বলছিলো, "ভালো কোনো বই তো পাবি না; ৭৫' এর পর ওনাকে নিয়ে কোনো কাজই করতে দেয়া হয়নি!" সত্যিই তাই ছিল ব্যাপারটা। তখনও প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী-বিএনপি রাজনীতির মধ্যে ফেলে দ্বিখণ্ডিতই করছিলো। আর জিয়াউর রহমানের সাথে তুলনা করে আরেকদফা ছোট করতেই ব্যস্ত ছিল।

অপপ্রচারে ভ্রান্ত আমাদের প্রজন্মের সেই যুগ শেষ হলো; মাঝে গড়ালো অনেক জল। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আওয়ামী লীগের দশ বছর মেয়াদি শাসন হয়তো আজকের প্রজন্মকে আমাদের মতো পথভ্রষ্ট করে রাখতে পারেনি; তারা জেনেছে বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম, আদর্শ, দেশের জন্য আত্মত্যাগ, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসার কথা। সর্বোপরি, বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর মতো অবিসংবাদিত নেতা যে আর বেশি নেই এবং এমন একজন দূরদর্শী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব তাঁর সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন এই জাতির জন্য- এইটুকু যে কতোটা গৌরবের সেটি স্বাধীনতার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরের প্রজন্ম দল-মত নির্বিশেষে অনুভব করছে।

এসেছে "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" : একজন ক্ষণজন্মা মুজিবর কি করে হেসে-খেলে ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের নেতা হয়ে উঠলো সেটা এই দূরের প্রজন্ম প্রত্যক্ষ করে বুঝলো, সব দেশে, সব কালে একজন মুজিব জন্মায় না। বেশ কয়েকটি অনলাইন রিসোর্স ও অনেক তরুণ গবেষক মিলে আমাদেরকে পৌঁছে দিলো হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় দিনগুলিতে। আমরা জেনেছি, এমন এক নেতা আমাদের ছিল যিনি সারা বিশ্বের স্বনামধন্য সব নেতাদের নেতা! আমরাই ছিলাম বিশ্বের সবচে' সাহসী ও ক্ষমতাবান নেতার একমাত্র দুর্বলতা। অথচ আমরা সেই অহংকার আর গৌরবকে হারিয়ে গরিব ও হীন-ঐতিহ্যের জাতিতে পরিণত হয়েছিলাম।

বিশ্বের সব অখ্যাত ও নিন্দিত নেতৃত্বই আমাদের জাতির ভবিষ্যত নির্ধারণ করছিলো, যাদের ছিল সবচে' সমৃদ্ধ ইতিহাস! আজ যখন দেখি ১৭ মার্চ বা ১৫ আগস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার নিউজফিড বঙ্গবন্ধুর ছবি ও কথায় ভরে যায়; আওয়ামী লীগ সরকারের তীক্ষ্ণ সমালোচকও বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে; মনে হয় এই প্রজন্ম তাদের হারিয়ে ফেলা গৌরবকে মনের অজান্তে খুঁজে ফিরছে!

তবুও বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার মতো স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর রক্তও আমাদের জানান দিলো, একজন নেতাই একটি বিশ্বাস হন্তারক জাতিকে উদ্ধার করার জন্য যথেষ্ট নয়! বঙ্গবন্ধুকে আমরা হারিয়েছি কারণ সেইসময় আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি দেশের জন্য নিবেদিত থাকলেও তাঁর আশে-পাশের অনেকেই রাজনৈতিক আদর্শ ও ব্যক্তি স্বার্থের বিভেদে বিভক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর দেশপ্রেম, মহত্ত্ব, ভালোবাসা ও উদারতায় আকাশ ছুঁয়েছিলেন আর সেই অন্ধ ভালোবাসার মাশুল দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে। তাই এবার ১৫ আগস্টে আমাদের এই প্রজন্মকে আরেকবার নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে দেশকে ভালোবেসে, এটিই আমাদের একক সীমারেখা। দল বা ব্যক্তির বিভক্তি হয়; কিন্তু সকল দেশপ্রেমিক একটি আদর্শেই বাঁধা থাকে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন