চামড়া নাটক
প্রতি ঈদে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচুর নাটক প্রচার হয়। এসব নাটক কেউ দেখে, কেউ দেখেনা। যারা দেখেনা তারা পরে ইউটিউবে দেখে নেয়, কারণ সেখানে এগুলো বিজ্ঞাপনের ঝামেলা ছাড়া দেখা যায়। ঈদের নাটক উৎসবের নাটক, তাই বেশিরভাগই থাকে কমেডি ঘরানার। মানুষকে আনন্দ দেবার চেষ্টা থাকে বিষয়বস্তুতে।
তবে এবার ঈদ উল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে যে নাটক হয়েছে সেটাই বেশি দেখতে হয়েছে সারাদেশের মানুষকে। কমেডি নয়, এই নাটক ছিল ট্র্যাজেডিতে ভরপুর। বেদনার্ত, বিপর্যস্ত, পরাজিত হয়ে মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা শেষ পর্যন্ত চামড়া রাস্তার পাশে ফেলে চলে গেছেন, কেউবা দল বেঁধে চামড়াকে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। এক লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ১০০ টাকাও শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি। একজন আমাকে বলেছেন তার এক লাখ টাকা দামের চামড়া তিনি বিনে পয়সায় দিয়ে সাথে রিকশা ভাড়াও দিয়ে দিয়েছেন।
বলা হচ্ছে ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেট পরিকল্পনা করে চামড়ার বাজারে ধস নামিয়েছে। তারা এমন এক সিস্টেম করেছে যে সরকার গরু ও খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেটা কেউ মানেনি। আর এই যে মানেনি, সেজন্য কোন ব্যবস্থাও সরকার নেয়নি। বরং আমরা দেখলাম ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থেকে মন্ত্রী হওয়া বাণিজ্যমন্ত্রী অসহায়ের মতো বলছেন, চামড়ার বাজারে এই ধস নামার পেছেনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে।
প্রশ্ন হল শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে যারা আছেন তারা কি করছেন? মন্ত্রী যদি কারসাজি বুঝেই থাকেন তাহলে ব্যবস্থা নিয়েছেন একজনের বিরুদ্ধেও? সরকার নির্ধারিত দাম যে কার্যকর হল না, সেই ব্যর্থতার দায় কি তিনি নিবেন? তিনি কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু দেখা গেল সেটার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে ট্যানারি শিল্প মালিকরা।
গত কয়েক বছর ধরেই কোরবানির চামড়া নিয়ে নানা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। এর পেছনে কাজ করে দুটি চক্র - আড়তদার আর ট্যানারির মালিক। সামান্য কিছু আয়ের আশায় আর্থিকভাবে নাজুক অবস্থানে থাকা বেকার ও স্বল্প আয়ের মানুষ ঘরে ঘরে গিয়ে, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করে। এই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সর্বস্ব লুটে নেয়ার সব আয়োজন করে এই দুটি চক্র।
কখনও বলা হয়, বাজারে লবণের সংকট, লবণ না থাকায় চামড়া সংরক্ষণ করা যাবে না, তাই স্বাভাবিক দরে চামড়া কেনা যাবে না। কখনও আন্তর্জাতিক বাজারের ধসের দোহাই দেওয়া হয়। আর পুঁজি সংকটের, মুখস্থ কথাতো আছেই। আর এসব করাই হয় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। সরকার কিছুই করেনা, ‘খতিয়ে দেখা হবে’ জাতীয় বক্তব্য দিয়ে তারা সময় নেন নতুন বছর এলে আবার কি বলা হবে সেটা বলার জন্য।
সরকারের উন্নয়নী ভাবমূর্তির সঙ্গে বাস্তব কতটা মেলে এই ধরনের ইস্যুতে টের পাওয়া যায়। কৃষক ধানের দাম পায় না, মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত দামও পায় না। উভয় ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের কারসাজিটা বোঝা যায়, কিন্তু সিন্ডিকেট হোতাদের কোন শাস্তির আওতায় আনা যায় না। কারণ তার নিজেরা বিত্তশালী, ক্ষমতাশালী এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের যাতায়াত।
নানা সময়ের নানা প্রণোদনায় দেশি চামড়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু চামড়া বাজার অস্থিতিশীলই থেকে গেছে। এ বছর অস্থিতিশীলতার চরম প্রকাশ দেখা গেল। এই যে কাণ্ডগুলো ঘটল– চামড়া ফেলে দেওয়া হল, পুঁতে ফেলা হল, এগুলো সবই বিশ্বের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক দেখেছে এবং আমাদের চামড়াজাত শিল্পের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি মাথায় রাখবে।
যদি আমরা সত্যি সত্যি বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি তাহলে চামড়ার ক্ষেত্রেও চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতেই বাজার তার চরিত্র নির্ধারণ করত। কিন্তু সরকার চেষ্টা করেছে বাজারে তার একটা নিয়ন্ত্রণ থাকুক। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণকে কব্জায় নিয়েছে ব্যবসায়ীদের বৃহৎ সিন্ডিকেট এবং সিস্টেমের দোষে সরকার বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থই দেখে চলেছে।
ট্যানারির মালিকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে একটা দাম বেঁধে দেন। তাই তাদের এই একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ করতে এ বছর কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়। এতে এখন আড়তদারেরা চাইলে ট্যানারিতে চামড়া না দিয়ে সরাসরি রপ্তানি করতে পারবেন। ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, আড়তদারেরা নিজেরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। এতে তারাই লাভবান হবেন। আর আড়তদারদের অভিযোগ, ট্যানারির মালিকেরা গতবারের চামড়ার দাম পরিশোধ না করায় এবার বেশির ভাগ আড়তদার বা ব্যবসায়ী চামড়া কেনেননি। ফলে চামড়ার দাম কমে গেছে।
এগুলো পুরোনো কথা, সরকার জানে। ট্যানারি মালিকদের একটি অংশ আছে যারা বড় অংকের ঋণ খেলাপী। আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা কি ধরনের কারসাজি করছে তা যেহেতু জানা, মন্ত্রী নিজেই বলেছেন, তাই প্রত্যাশা থাকবে যে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এই খাত নিয়ে একটা দীর্ঘ পরিকল্পনাও প্রয়োজন। চামড়া শিল্পের ক্ষেত্রে পুরো সাপ্লাই চেইন সমন্বিতভাবে দেখা প্রয়োজন। গবাদিপশুর উৎপাদন, মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য ও চামড়া নিয়ে সমন্বিত নীতি কাঠামো নিয়ে এগুতে না পারলে প্রতিবছর চামড়া নাটক দেখতে হবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম