ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মশা আমাদের কী শেখালো

আমীন আল রশীদ | প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ১৬ আগস্ট ২০১৯

বলা হয়, জগতের কোনো কিছুই অহেতুক সৃষ্টি নয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীও কোনো না কোনোভাবে মানবজাতির কাজে লাগে। এর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা কিছু জিনিস মানুষের জন্য পাঠান তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। এখন দেশব্যাপী ডেঙ্গুর যে মহামারি এবং ভয়াবহ আতঙ্ক, তাতে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা সামান্য এডিস মশা দিয়ে আমাদের বড় কোনো শিক্ষা দিচ্ছেন অথবা কিছু বিষয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, সেই শিক্ষাটা কী?

খেয়াল করে দেখবেন এবারের ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ও আতঙ্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যদিও এটি নতুন কোনো রোগ নয় বা শুধু বাংলাদেশেই যে এই রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাও নয়। ফিলিপাইনে ছয়শোর বেশি মানুষ মারা যাওয়ার পর এটিকে সে দেশে ‘জাতীয় মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত অন্তত এক লাখ ৪৬ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা ৯৮ শতাংশ বেশি। আর এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন প্রায় সাতশো মানুষ।

আশা করা যায় গরমের দাপট ও বৃষ্টি কমলে, অর্থাৎ শরতের মাঝামাঝি এবং হেমন্তের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আরও কত হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হবে এবং মারা যাবে, তা বলা মুশকিল। সুতরাং আমাদের এখন এই প্রশ্নটি নিজেদের করা দরকার যে, সামান্য এডিস মশা আমাদের কী কী শিখিয়ে গেল এবং আমরা আদৌ কিছু শিখলাম কি না।

১. অব্যবস্থাপনা; মশা আমাদের জানিয়ে গেল আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়লেও, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা আট লেনের মতো অবকাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও সামান্য মশার বংশ বিস্তার এবং তার হাত থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। মশা আমাদের দেখিয়ে গেল, নাগরিক সুবিধার স্বার্থে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগ করা হলেও বস্তুত রাজধানীতে নাগরিক সেবার কোনো উন্নয়ন হয়নি। মশার বংশ বিস্তার রোধের বড় দায়িত্ব নাগরিকদের নিজেদের এ কথা ঠিক; কিন্তু প্রতিটি ওয়ার্ডে যে কাউন্সিলররা রয়েছেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রী রয়েছেন, তারা নাগরিকদের কোনো সেবায় কি আদৌ আসছেন নাকি কীভাবে নিজেদের সেবা করা যায়, সেই ভাবনায় ব্যস্ত ঢাকা দুই সিটির কতজন নাগরিক তার ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের নাম জানেন বা চেহারা দেখলে চিনবেন। নাগরিকদের সাথে কাউন্সিলরদের ছয় মাসেও একবার দেখা হয় কি, সিটি কর্পোরেশনে বেতনভুক্ত যে পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং বিশেষ করে মশা নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত যে ব্যক্তিরা মাসে মাসে বেতন নেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর আগে সবশেষ করে তাদের আপনি দেখেছেন? যে ওষুধ তারা মশা মারার কাজে ব্যবহার করছেন সেগুলো যে কার্যকর নয়, তা খোদ কর্তৃপক্ষই স্বীকার করেছে। এই কাজে নিয়োজিত কর্মীদের অদক্ষতাও চোখে পড়ার মতো। হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে তাদের কেউ কেউ মানুষের গায়ের উপরে মশার ওষুধ স্প্রে করেছেন, এমন ছবিও গণমাধ্যম ও সোশ্যলা মিডিয়ায় এসেছে। প্রশ্ন হলো কোন যোগ্যতায় এই লোকগুলোর চাকরি হলো?

২. দায় এড়ানো; ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ তথা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একের পর এক মৃত্যু এবং হাসপাতালে রোগীর অভূতপূর্ব চাপ তৈরির আগ পর্যন্ত ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেননি ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন। বরং তিনি এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনেন। একই সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এডিস মশার প্রজননের তুলনা করেন। এ রকম একটি সিরিয়াস বিষয়ে দায়িত্বশীল পদের লোকদের এ রকম লাগামহীন কথাবার্তা সাধারণ মানুষের মনে বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর তথ্য চিকিৎসরা জানালেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তা স্বীকার করেননি। বস্তুত এসব ঘটনায় দায়িত্বশীলরা নিজেদের দায়িত্ব এড়ানো এবং ব্যর্থতা ঢাকতে চান। ফলে এ রকম বড় ঘটনায় মানুষ জানতে পারে কারা তাদের জনপ্রতিনিধি এবং তাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মান কেমন।

৩. দুই মেয়রের তফাৎ; এবারের ডেঙ্গুতে ঢাকার দুই অংশের দুই মেয়রের আচরণ ও কথাবার্তায় সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। দক্ষিণের মেয়র শুরু থেকেই যেভাবে ডেঙ্গু ও এডিস মশা নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন, উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম সেখানে তুলনামূলক সংযত ছিলেন। পারতপক্ষে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছেন শুধু নয়, ডেঙ্গুতে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।

৪. ব্যক্তিগত ও সামাজিক অসচেতনতা; নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের অন্যান্য দফতরের দায়িত্ব আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আপনি নিজে কতটা সচেতন আপনার বাসায় খোলাপাত্রে জমে থামা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। ফুলের টবে জমে থাকা পানি, টায়ারের খোল, ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা অথবা পানির চৌবাচ্চায়ও এই মশা নির্বিচারে বংশ বিস্তার করে। এসি ও ফ্রিজে জমা পানিও এডিস মশার পছন্দ। কিন্তু এবারের ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর আগে কখনও কি আপনি নিজের বাসার কার্নিশ, ছাদ ও আশপাশে খেয়াল করে দেখেছেন কোথাও পানি জমে আছে কি না কিংবা মশার বংশ বিস্তারের মতো উপযোগী পরিবেশ রয়েছে কি না আবার ব্যক্তিগতভাবে আপনি নিজের বাসাটা পরিষ্কার রাখলেন; কিন্তু আপনার পাশের বাড়ির খবর নিয়েছেন কারণ এডিস মশা যেখানে জন্মায় সেখান থেকে তিন থেকে চারশো মিটার পর্যন্ত সে উড়ে যেতে পারে। সুতরাং আপনার বাসায় এডিস মশার আস্তানা নেই বলেই যে আপনি নিরাপদ, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। পাশের বাড়ির মশায় আপনার খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে হুল ফুটিয়ে চলে যেতে পারে। সুতরাং নিজে বাঁচলে বাপের নাম- এখানে সে কথা খাটবে না।

৫. স্বেচ্ছায় রক্তদান; ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা গুরুতর হলে প্লাটিলেট নেমে যায় এবং তখন তাকে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটেনি যেখানে অনেক লোকের একসাথে এ রকম রক্তের প্রয়োজন হয়। এমনিতেই এখনও আমাদের দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কম এবং রক্ত দেয়া নিয়ে ভীতি ও ভুল ধারণাও রয়েছে। আবার অন্যান্য অস্ত্রোপচার বা রোগের ক্ষেত্রে যেমন একবারে এক বা দুই ব্যাগ রক্ত দিলেই হয়, সেখানে ডেঙ্গু রোগীকে প্লাটিলেট দিতে গেলে একসাথে চারজন রক্তাদাতার প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় কারও যদি নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয় তখন সংকট আরও ঘণীভুত হয়। ফলে এবার এডিস মশা আমাদের এটিও জানিয়ে গেল যে, সারাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তাদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে; এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিতে হবে। শুধু বেসরকারি উদ্যোগে নয়, এ বিষয়ে সরকারকেও কর্মসূচি নিতে হবে।

৬. বিকেন্দ্রীকরণ; সদস্যপ্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে নিয়ে যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের সবকিছু ঢাকানির্ভর বা ঢাকাকেন্দ্রিক হতো না এবং পুরো বাংলাদেশের ভার এই একটি নগরীকে নিতে হতো না। গত তিনটি সংসদে এরশাদ যতবার ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি বারবারই একটি বাক্য বলেছেন, ‘টেক বাংলাদেশ আউট অব ঢাকা’, মানে বাংলাদেশকে ঢাকার বাইরে নিতে হবে। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বা অসুস্থ বোধ করে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে নিজের বাড়ি চলে গেছেন। কিন্তু ঢাকার বাইরে জেলা-উপজেলা শহরগুলোর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের লোকবল ও যন্ত্রপাতি সংকটসহ নানা কারণেই একসাথে এত ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া শুধু কঠিন নয়, কখনও এটি অসম্ভবও। এর মূল কারণ ঢাকার বাইরে এখনও কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো নাগরিকের চিকিৎসা দেয়ার জন্য যথেষ্ট উপযোগী নয়। ছোট শহরে গিয়ে ডাক্তাররা থাকতে চান না। ফলে চিকিৎসক সংকট লেগেই থাকে। অনেক যন্ত্রপাতি নেই। থাকলেও অকার্যকর। কিন্তু প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ হলে, অর্থাৎ সবকিছু ঢাকানির্ভর বা রাজধানীকেন্দ্রিক না হলে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠত।

অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বচ্ছল মানুষের পেট খারাপ হলেও ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় আসেন। এটি তো হবার কথা ছিল না। প্রত্যেক নাগরিক যদি তার এলাকাতেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতেন, তাহলে সব চাপ রাজধানীর হাসপাতালগুলোর ওপর পড়ত না এবং চিকিৎসাকে তখন একশ্রেণির লোক ব্যবসায় পরিণত করে মানুষের পকেট কাটার মেশিন বানাতে পারত না। সুতরাং এডিস মশা আমাদের আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, আমাদের ডিসেন্ট্রালাইজেশন বা বিকেন্দ্রীকরণ কতটা জরুরি।

৭. পরিসংখ্যান বিভ্রান্তি; যেকোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি, বিশেষ করে মানুষের মৃত্যুর পরিসংখ্যান বরাবরই বিভ্রান্তিকর। প্রতিটি ঘটনায় সরকার যে মৃত্যুর হিসাব দেয়, তার সাথে বেসরকারি হিসাব মেলে না। যে কারণে সাংবাদিকরাও লেখেন, সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এত, বেসরকারি হিসাবে এত। দেখা যায় সরকারি ও বেসরকারি সংখ্যার মধ্যে ফারাক থাকে অনেক। এটি তো হবার কথা নয়। সরকার মূলত দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কম দেখাতে চায় নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য। কিন্তু এভাবে কি দায় এড়ানো যায় এবার ডেঙ্গুতেও এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মৃত্যুর যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি।

তালিকা করলে হয়তো আরও অনেক কিছুই লেখা যাবে যা এবার এডিস মশা আমাদের শেখালো। তবে মশা আমাদের সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি শেখালো বা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো, তা হচ্ছে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসেও রাষ্ট্রে কোনো ‘সিস্টেম ডেভেলপ’ করতে পারলাম না। কোনোকিছুই এখানে নিয়ম মেনে বা পদ্ধতিগতভবে হয় না। যখনই বড় কোনো সমস্যা আসে সেটির তাৎক্ষণিক বা অ্যাডহক অর্থাৎ আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি কোনো ভাবনা নেই। এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েছে বলে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। আগামী বছর যদি এ রকম বিপর্যয় না হয়, দেখা যাবে মশা মারা তথা জন্মাতে না দেয়ার বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের যে দায়িত্ব, সেটি তারা বেমালুম ভুলে যাবে। কিন্তু এই দায়িত্বে নিয়োজিতরা ঠিকই মাসে মাসে বেতন নেবেন। ওষুধ কেনার নামে বাজেট হবে এবং যথারীতি জনগণের সেই পয়সা লোপাটও হবে। সাংবাদিকরা অনুসন্ধান না করলে সাধারণ মানুষ সেটি জানতেও পারবে না।

আমীন আল রশীদ বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

বিএ/এমএস

আরও পড়ুন