সেলফিহীন ঈদ-বন্যা
ক্ষতচিহ্ন রেখে নেমে গেছে বানের পানি। বন্যাপরবর্তী দুর্ভোগ সইছে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের মানুষ। এবারের বন্যায় তাদের পাশে তেমন কাউকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে রাজনীতির মানুষরা এবার ত্রাণ দেয়ার গরজ করেননি।
কিছু এলাকায় মন্ত্রী-এমপিরা যতসামান্য ত্রাণ বিতরণের ফটোসেশন করেছেন। ত্রাণের ছবি তুলতে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ত্রাণ বিলিয়ে সরে পড়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরে সরে থেকেছেন। তারা দুষছেন ওপর থেকে ত্রাণ না আসাকে। এবার ত্রাণ নিয়ে যায়নি এনজিওরাও। বিত্তবানরাও টুকিটাকি সহায়তা দিয়ে সেলফি ছেড়েছেন।
এবার পানিতে ডুবে, ত্রাণের অভাব ও বিভিন্ন রোগব্যাধিতে কতজন ইহলোক ত্যাগ করেছেন, সেই হিসাব নিয়েও গোলমাল। প্রতিবারের বন্যায় কত সংখ্যক মানুষ বসতভিটা হারায়, কত সংখ্যক মানুষ জমি হারায়, কত সংখ্যক সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়- এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। হতভাগা বন্যার্তরা ধরেই নিয়েছেন আল্লাহ ছাড়া তাদের পাশে কেউ নেই। কেন এবার বন্যার্তদের নিয়ে এমন হৃদয়হীনতা? এর জবাব বিস্তর। নানামুখীও। রাজনীতিহীনতার কারণে রাজনীতিকদের মধ্যে ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাওয়া, দুর্গতদের মন পাওয়ার বালাই নেই।
এমনকি এবার গণমাধ্যমেও বন্যার খবর গুরুত্ব কম পেয়েছে। হাজার হাজার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বেঁচে থাকার আর্তির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট, এরশাদের মৃত্যু, বরগুনার মিন্নি, নয়ন বন্ড ইত্যাদি। ধানের কম দাম, কর্মসংস্থানের অভাব, এর সাথে বন্যার থাবা যোগ হয়ে উত্তরবঙ্গের দরিদ্র মানুষগুলো কী অবস্থায় আছে তা বোঝার জন্য পরিব্রাজক বা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হতে হয় না।
বাংলাদেশে বহুকাল আগে থেকে বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ছা হানা দেয়। যেকোনো দুর্যোগে বা বিপদে এ দেশের সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসা অনেকটা সংস্কৃতির মতো। তখন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ কথাটি খুব শক্তি ও সাহস জোগায়। এবার সেখানেও দুঃখজনক ভিন্নতা। বিভিন্ন দল নিজেদের প্রচারের জন্য হলেও এ উছিলায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায়। আর ক্ষমতাসীনরাও ত্রাণকাজে নেমে বিরোধীদলকে ঘায়েল করে। এবারের বন্যায় সেখানেও ব্যাপক ছন্দপতন। দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর দরকার মনে করেনি কোনো পক্ষই। আক্রান্তরা বলেছেন, শতাব্দীর মধ্যে তারা এত বড় বন্যা দেখেনি। শতাধিক মৃত্যুর বাইরে অসংখ্য সহায়-সংসার ভেসে গেছে। কৃষকের জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
অনেকের অভিযোগ, এবার বিপর্যয়ের মাত্রা যত বেশি, সরকারি-বেসরকারি সাড়া তত কম। একসময় আমাদের জাতীয় নেতারা সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে চিন্তা করতেন, পাশে দাঁড়াতেন। সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় গিয়ে সরকারের উদ্দেশে মাওলানা ভাসানী বলেছেন, ‘ওরা এবারও আসেনি’। বঙ্গবন্ধুর বইতে আছে, ‘খবরের কাগজে এসেছে...সিলেটে বন্যায় দেড় লক্ষ লোক গৃহহীন, ১০ জন মারা গেছে। কত যে গবাদিপশু ভাসাইয়া নিয়ে গেছে তার কি কোনো সীমা আছে। কী করে এ দেশের লোক বাঁচবে তা ভাবতেও পারি না’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮৭ ]।
আজকের লেখায় আবুল মনসুর আহমেদের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ গল্পের কয়েক লাইন উল্লেখ করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন এমন বন্যার কথা, ‘...সারাদেশ ভাসিয়া গিয়াছে। গ্রামকে গ্রাম ধুধু করিতেছে। বিস্তীর্ণ জলরাশির কোথাও কোথাও ঘরের চাল ও বাঁশের ঝাড়ের ডগা জাগাইয়া লোকালয়ের অস্তিত্ব ঘোষণা করিতেছে।...দুপাশের দু-দশখানা গ্রামের সমস্ত লোক আসিয়া এই সড়কের ওপর আশ্রয় লইয়াছে। রেলসড়কে তিলধারণের স্থান নাই। মানুষ, পশু, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া গা ঘেষাঘেষি করিয়া সড়কের ওপর ভিড় করিয়া নৈসর্গিক বিপদের সাম্য-সাধনা-ক্ষমতা ঘোষণা করিতেছে।’
আবুল মনসুর আহমেদের সেই গল্পের বর্ণনা এবারের বন্যায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বন্যার পর ঈদও উদযাপন করেছে বন্যার্তরা। বিশেষ বার্তা বা আনন্দ বয়ে না আনলেও ঈদ তাদের খোঁচা দিয়ে গেছে মরার ওপর খাড়ার ঘাঁয়ের মতো। দুর্গতির সময় যখন কেউ থাকেনি, ঈদ আনন্দের মৌসুমেই বা থাকবে কেন?- এ প্রশ্নের জবাব তারা পেয়েছে হাড়ে হাড়ে।
লেখক: সাংবাদিক- কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইআর/বিএ/জেআইএম