একটি ব্যক্তি উদ্যোগ এবং শতমুখের হাসি
আমরা প্রায়ই মানুষকে বলতে শুনি, ‘সমাজটা বদলে দাও।’ সমাজ বদলে দেয়ার জন্য কি করতে হবে সেটা কিন্তু অনেকেই বলেন না। একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়, সামষ্টিকভাবে কি সমাজ বদলে দেয়া যায়? সেটা হয়তো যায়, কিন্তু সামষ্টিকতাকে ভেঙে ‘একক’ করে ফেলুন! দেখবেন, সেখানে ব্যক্তিই হয়ে উঠেছে প্রধান।
একজন একজন করে ব্যক্তি যদি নিজেদের বদলে ফেলতে পারে, তাহলে সমাজ বদলে যাবে। সমাজ বদলে গেলে জাতি এবং রাষ্ট্র বদলে যাবে। শেষ পর্যন্ত পুরো দেশটাই বদলে যাবে, অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হবে সারা পৃথিবীতে।
এসবই আসলে কথার কথা। বইয়ের পাতায় শোভা পায়। কখনও কখনও পত্রিকার কলামেও উঠে আসে; কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের সমাজ বদলে দেয়ার মতো মানসিকতা ক’জনের আছে? বাংলাদেশে অন্তত সেটার স্বপ্ন দেখা বাতুলতা বৈ কিছু নয়। জনে জনে বদলে যাওয়ার ঘটনা তো নাই-ই বরং ‘আপনি বাঁচলে, বাপের নাম’- মানসিকতা আমাদের সবার মাঝে।
কিন্তু বাংলা ব্যাকরণে ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ বলে একটা কথা আছে। স্রোতের বিপরীতে চলার বিষয়টাই নিপাতনে সিদ্ধ। সেই স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ বাংলাদেশেও আছে। এখানে একক কোনো ব্যক্তির চেষ্টায় সমাজে ভালো কোনো কিছু হওয়ার ঘটনা আছে। বিরল হলেও একেবারেই যে নেই তা নয়। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক ভালো ভালো কাজ কিন্তু হচ্ছে। এসব ব্যক্তি উদ্যোগই পরে পরিণত হয় সামষ্টিক উদ্যোগে; কিন্তু সেখানেও কোনো ‘এককে’র ভূমিকাই থাকছে প্রধান।
এ ধরনের উদাহরণ আমরা কিন্তু হরহামেশা দেখতে পাই বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে। কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে। কিছু কিছু সংগঠনও গড়ে উঠেছে কোনো একটা নির্দিষ্ট সেক্টরে ভালো কোনো কাজ করার লক্ষ্যে।
ব্যক্তি উদ্যোগের নজির খুঁজতে গেলে অনেক পাওয়া যাবে। তবে এবারের ঈদুল আজহায় এমন একটি ব্যক্তি উদ্যোগের কথা আজ অবতারণা করবো, যেটা শুনলে আরও হাজারো মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে ভবিষ্যতে এমন ভালো কাজ করার জন্য। লাখো মানুষের মুখে হয়তো তখন ফুটে উঠবে সুখের হাসি।
জানি না কীভাবে তার মাথায় চিন্তাটি এলো। জাগো নিউজের সহকারী বার্তা সম্পাদক (এএনই), মফস্বল সম্পাদক মাহাবুর আলম সোহাগকে দেখলাম ঈদুল আজহার সপ্তাহ খানেক আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে। উত্তরবঙ্গের বন্যাকবলিত কোনো দরিদ্র এলাকায় একটি গরু কোরবানি দিয়ে সেই গরুর গোস্ত সেখানকার দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে চান তিনি। ফেসবুক বন্ধুদের কাছে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, অন্তত ১০ টাকা করেও যদি তারা এ জন্য দান করেন, তাহলে কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা উঠবে এবং তিনি তার চাহিদা মতো কোরবানি দিয়ে দরিদ্র মানুষদের মাঝে গোস্ত নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন।
স্ট্যাটাসটা দেখার পর মনে হলো, আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও মাহাবুর আলম সোহাগের পক্ষে এটা সম্ভব। তার বন্ধু তালিকায় এমন এমন মানুষ আছেন, যারা একজন কিংবা দু’জন মিলেও তার এই চাওয়াটা পূরণ করে দিতে পারেন। এর আগেও নানা মানবিক কাজে তার আহ্বানে যেভাবে সাড়া পড়তে দেখেছি, তাতে এবারের এ কাজটিকে তাই আমার কাছে অন্তত অসম্ভব মনে হয়নি।
তবে বাংলাদেশে একটা ট্রাডিশন খুব চালু আছে। আপনি একটা ভালো কাজ করতে মাঠে নামবেন, সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ আপনার এ ভালো কাজে বাধা দেবে। না পারলে সমালোচনা হলেও করবে। এ ক্ষেত্রে সোহাগ ভাইকেও যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি, তা নয়। তার স্ট্যাটাসের নিচেই কাউকে কাউকে কমেন্টস করতে দেখেছি, ‘নতুন ধান্দা!’ বলে।
সে যাই হোক, মাহাবুর আলম সোহাগের ফেসবুক বন্ধুরা তাকে হতাশ করেননি। নির্দিষ্ট দিনের আগেই তার ৯১ জন ফেসবুক বন্ধু মিলে ৭৩ হাজার টাকার বন্দোবস্ত করেছেন। যার মধ্যে প্রায় ৫৪ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হলো গরু। বাকি টাকা দিয়ে কেনা হলো আটা, তেল, লবণ, হলুদ-মরিচ এবং মসলা।
ঈদের দিন সকালে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া এলাকায় সেই গরু কোরবানি দেয়ার পর স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদ খন্দকারের তত্ত্বাবধানে ১০০ জন বাছাইকৃত দরিদ্র-অভাবী মানুষের মাঝে গোস্ত বিতরণ করা হলো। মাহাবুর আলম সোহাগ ঢাকায় বসে উদ্যোগ নিয়েছেন, টাকার ব্যবস্থা করেছেন, আর গাইবান্ধার স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদ খোন্দকার তার উদ্যোগটা বাস্তবায়ন করেছেন। একজনের ইচ্ছা, ৯১ জনের সহায়তা এবং সর্বশেষ অন্য একজনের তত্ত্বাবধানে পুরো বিষয়টা বাস্তবায়ন হলো। উদ্যোগটা শেষ পর্যন্ত রূপ নিল ‘সমষ্টিগত’ হিসেবে। কিন্তু এ সমষ্টির জন্ম হয়েছে মাহাবুর আলম সোহাগের ‘একক’ চিন্তা থেকেই।
সোহাগ তার এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রতিটি আপডেট দিয়েছেন ফেসবুকে। গরু কোরবানি দেয়ার পর দরিদ্রদের মাঝে বিতরণের দৃশ্য এবং ভিডিও’ও দিয়েছেন। অন্তত তাকে যারা টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, তারা এসব দেখেছেন- কীভাবে একটি ছোট্ট ভালো চিন্তা শত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে!
ভয়াবহ বন্যায় যেখানে মানুষের ঠিকমতো দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার জোগাড় পর্যন্ত নেই, তাদের কপালে কখনও কোরবানির দু’দুকরো মাংস জুটবে, তা হয়তো কল্পনায়ও ছিল না। মাহাবুর আলম সোহাগের উদ্যোগ একশটি পরিবার তো অন্তত এই শূন্যতা বুঝতে পারেনি!
খুবই ছোট উদ্যোগ। কিন্তু ব্যপ্তিটা অনেক বড়। পুরো দেশের দরিদ্র মানুষের এলাকার মানচিত্র এঁকে এই উদ্যোগটাকে চিত্রায়ন করলে কলমের ফোঁটার কয়েক সহস্র ভাগের একভাগেও হয়তো আসবে না এই বিষয়টি; কিন্তু একটা উদাহরণ তো স্থাপিত হলো! এভাবে সারাদেশে জনে জনে যদি ছোট ছোট উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে সমাজটা বদলে যেতে কি খুব বেশি সময় লাগবে? লাগার কথা নয়।
ভালো কাজে উৎসাহ দেয়ার জন্য কিছু কিছু উদাহরণ তৈরি করা প্রয়োজন হয়। সেই উদাহরণটা হয়তো তৈরি করেছেন মাহাবুর আলম সোহাগ। তিনি নিজেই সর্বশেষ দেয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমার ছোট এ উদ্যোগটিতে এত মানুষের সাড়া এবং এত সুন্দরভাবে সফল হবে- সেটি ভাবতেই ভালো লাগছে। আল্লাহ আগামীতেও এমন কাজ করার তৌফিক দিও মাবুদ। এ উদ্যোগে ৯১ জন বন্ধু আমার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখায় আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। আজকের এ সফলতায় একটি জিনিস আবারও প্রমাণিত হলো, নিয়ত ভালো রেখে সততার সঙ্গে কোনো কাজে নামলে আল্লাহ সফলতা দেবেনই। আমাদের সমাজে ছোট ছোট উদ্যোগের অভাবে বড় বড় অনেক কাজ থমকে আছে। অথচ কেউ একজন সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে এলেই অনেকেই পাশে দাঁড়াবেন তার।’
মাহাবুর আলম সোহাগ পেশায় সাংবাদিক; কিন্তু সাংবাদিকতার পাশাপাশি মানবিক কিছু কাজ করে দারুণ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। তার উদ্যোগে অনেক জটিল-কঠিন রুগিকে ঢাকায় এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জটিল রোগ সম্পন্ন কিংবা অসহায় কোনো মানুষ তার কাছে ছুটে আসে একটু সাহায্যের আশায়। সোহাগ ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলে কিংবা জাগো নিউজে একটা নিউজ করলেই অনেক সামর্থ্যবান মানুষ ছুটে আসে সেই ব্যক্তিকে সহায়তার জন্য। শুধু অসুস্থ রোগি নয়, অনেক অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রেখে চলছেন তিনি।
মানুষের জন্যই মানুষ। নিঃস্বার্থভাবে সমাজে কাজ করার মানুষের এখন খুব অভাব। হাতেগোনা কিছু মানুষ আছে এমন। একজনের ছোট্ট চিন্তা থেকে বড় কিছুর সূচনা হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছেন আমাদের সোহাগ ভাই। তার তৈরি করা এ উদাহরণ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সর্বস্তরে। মানুষরা সবাই মানবিক হয়ে উঠুক। সমাজে ভালো কোনো কিছু করার ছোট ছোট উদ্যোগ নিক। সেগুলোই একদিন বড় হবে। সামষ্টিক উদ্যোগে পরিণত হবে। তাহলেই হয়তো একদিন আমাদের সমাজটা বদলে যাবে। সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন বুঝি এভাবেই বাস্তবায়ন হবে একদিন! সেদিনটা কত দূরে???
আইএইচএস/পিআর