ডেঙ্গুতে মুছে যাচ্ছে উৎসবের আনন্দ
এ বছর ঈদের আনন্দ মুছে যাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপে। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু জ্বরে কেউ না কেউ ভুগছে। অনেকের ঈদ কাটছে হাসপাতালের বেডে অসুস্থ হয়ে, আবার কারও স্বজনের জন্য দুঃশ্চিন্তায় হাসপাতালের বারান্দায়।
ছোট্ট একটি পতঙ্গ কি মহাবিপদই না ডেকে এনেছে দেশে। আর আমরা যুদ্ধে শ্রান্ত হয়ে পড়ছি এই ছোট্ট পতঙ্গটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ে মাথা খোঁড়। কথাটি যে কত সত্যি তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি এখন। সময় থাকতে যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেত তাহলে আজ এত মৃত্যু দেখতে হতো না।
অবশ্যই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব ছিল মশা নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সেই দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের কর্মীরা পালন করেনি। ব্যর্থতার দায় শীর্ষপদ থেকে একেবারে নিম্নতম পদ পর্যন্ত কর্মরতদের। মশা ধ্বংসের জন্য ভেজাল বা অকার্যকর ওষুধ কেনার বেলায় যেমন দুর্নীতি করা হয়েছে তেমনি ফাঁকি দেওয়া হয়েছে মশার ওষুধ ছিটানোর বেলাতেও। যে যার লেভেল থেকে চরম দুর্নীতি আর ফাঁকিবাজি করার বিষময় ফল ফলেছে।
ঢাকা মহা-মশক-নগরী থেকে সারা দেশে ছড়িয়েছে রোগটি। শুধু মশার ওষুধ কেনা ও ছিটানোর বেলাতেই দুর্নীতি হয়েছে তা নয়। নগরী পরিস্কারের দায়িত্বও তো যথাযথভাবে পালিত হয়নি। ঢাকা শহরের ড্রেনগুলো আটকে গেছে ময়লায়। শহরে জলাবদ্ধতা প্রবল। এরফলে মশার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে গোটা শহর। ড্রেন ও জলাশয়গুলো যদি পরিস্কার রাখতো সিটি করপোরেশন তাহলে আজকে ডেঙ্গুর এত বাড় বাড়ন্ত হতো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দায়িত্বে চরম অবহেলা আর দুর্নীতি করে এখন ঝাড়ু আর ফগার মেশিন হাতে নিয়ে কর্তা ব্যক্তিরা তামাশা করছেন। সেই তামাশায় সামিল করা হয়েছে চিত্রতারকাদের। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে মরণশয্যায় শুয়ে তামাশা দেখতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
তবে এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, সিটি করপোরেশনের দুর্নীতি তো আছেই পাশাপাশি আমাদের অবহেলাও কিছুটা দায়ী ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য। আমরা যদি নিজেদের ঘরবাড়ি, ফুলের টব, রান্নাঘরের বালতি, বাড়ির আশপাশ পরিস্কার রাখতাম তাহলে কিছুটা হলেও মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
ঈদে পশু কোরবানি হয়েছে অনেকের বাড়িতে। ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে জমে থাকা রক্ত, আবর্জনা খুব ভালো করে পরিস্কার করে ফেলা প্রয়োজন অবিলম্বে। এটা করতে হবে নিজের দায়িত্বেই। এমনকি যারা কোরবানি দিতে পারিনি তাদেরও এই কাজটি করতে হবে নিজের সুরক্ষার তাগিদেই। অমুকে নোংরা করেছে, আমি কেন পরিস্কার করতে যাব, একথা ভাবার আর অবকাশ নেই। রোগ হলে তো সকলকেই ধরবে। মশা ধ্বংসে প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে নিজের সাধ্য অনুযায়ী। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের উপর ভরসা করে নিজের জীবন বিপন্ন করার আর সময় নেই এখন।
মশা এর আগেও বাঙালির জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। এদেশে যখন রেলগাড়ি চালু হলো তখন রেল রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট এবং সড়কপথ তৈরি করতে গিয়ে প্রবাহমান জলধারা বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো দেশের গ্রামাঞ্চল। ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে গিয়েছিল গ্রামীণ বাঙালি। কলকাতা ও ঢাকাতেও ম্যালেরিয়ার ছিল প্রবল প্রতাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সব ঝোপঝাঁড় পরিস্কার এবং মশার ওষুধ প্রয়োগ করে এদেশ থেকে মশা অনেকটা দূর করা হয়। কাজটি অবশ্য করা হয়েছিল সৈন্যদের রক্ষার জন্য সরকারি খরচে ও গরজে। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাঙালি রাজনীতিবিদ হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ঢাকাকে মশামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কার্যকরী ওষুধ প্রয়োগ করে মশা নিধন খুব কঠিন কাজ নয়। ওষুধে ভেজাল মেশানো তখনও এত প্রবল ছিল না।
বলা যায় তখনও ওষুধে পানি মেশানো হতো। এখনকার মতো পানিতে কয়েক ফোটা ওষুধ মেশানোর মতো নয়। সেই কয়েক ফোটাও আবার অকার্যকরী ওষুধ। এইভাবে জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা দুর্নীতি করে তারা খুনির চেয়েও অধম। কারণ একজন খুনির পক্ষে এইভাবে এত মানুষকে হত্যা করা সম্ভব নয়। এই সব দুর্নীতিবাজদের মৃত্যুদণ্ড দিলেও কম দেওয়া হয়। এদের বিচার হওয়া উচিত জনসমক্ষে, জনতার আদালতে। এত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে এখন এরা ঝাড়ু হাতে তামাশা করছেন। এই তামাশাটাই বোধহয় আমাদের পাওনা ছিল।
এদের কে বোঝাবে যে এখন এসব তামাশা না করে প্রয়োজন চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করা। ঢাকায় বিশেষভাবে ডেঙ্গু হাসপাতালের প্রয়োজন অবিলম্বে। আর পাশাপাশি বন্যার বিপদও কিন্তু রয়েছে। বন্যার পানি যখন টেনে আসতে থাকবে তখন আবার মশার প্রকোপ বাড়বে। তাই এখন জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক চিকিৎসা সহায়তা, পাশাপাশি আগাম সতর্কতা এটাই দরকার। সরকারের উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে নিজেরাও যথাশক্তিতে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় এগিয়ে যাই। তাহলেই হয়তো এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।
এইচআর/জেআইএম