অশান্তির পৃথিবী
অবরোধ, আনিশ্চয়তাসহ শত সমস্যার মাঝেই ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরের মানুষের বাস। উপত্যকার মানুষ এমন ভাগ্যকে এক রকম মেনেই নিয়েছে। তারা জানে, জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা তাদের জন্য নয়। তবুও নিশ্চয়ই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল আযহা উদযাপনের। কিন্তু ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তাদের জীবনে ঘটে গেল আরেক বড় পরিবর্তন। ভারতীয় সংবিধানে তাদের যে আলাদা মর্যাদা ছিল সেটা চলে গেল, কারণ শাসক বিজেপি সংসদ পাস করে নিল এক প্রস্তাব। জম্মু ও কাশ্মীরকে প্রদান করা বিশেষ আইনি অধিকার ও মর্যাদাকে বিলুপ্ত করা হল। কাশ্মীরের সাথে থাকা লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে নিয়ে আসা হল কেন্দ্রের অধীনে।
কাশ্মীরের মানুষ এখন নরকে বাস করছে বলা চলে। কার্ফু চলছে, টেলিফোন নেই, মোবাইল সংযোগ নেই, ইন্টারনেট বন্ধ, কেবল টেলিভিশন বন্ধ, ডাক যোগাযোগও বন্ধ। কাশ্মীরের ঘটনাক্রম নিয়ে গোটা ভারতে এবং ভারতের বাইরে প্রতিক্রিয়া চলছে, একমাত্র ব্যতিক্রম কাশ্মীর। কারণ, উপত্যকা হতে কোন কণ্ঠস্বর বহির্বিশ্বে যাচ্ছেনা। তাদের দুঃস্বপ্নের রজনী কত লম্বা পথে যাত্রা করল সময়ই বলবে।
পাকিস্তান স্বাভাবিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কিন্তু বালুচিস্তানের মানুষ জানে পাকিস্তানি সামরিক বুটের তলায় তাদের জীবন কাশ্মীরিদের মতই। আর শিয়া আর আহমদীয়া সম্প্রদায়ের জন্য পাকিস্তানে বেঁচে থাকাটাই অলৌকিকতা। চীন হালকা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায় কেমন আছে সেটাও বিশ্ববাসী জানে।
সিরিয়ায় এখনো শান্তি আসেনি, ইয়েমেনের মানুষের জীবনকে নরকের চেয়েও নরকময় করে রেখেছে সৌদি আরব। মিয়ানমার লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে, ধর্ষণ করে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করে ফেলল মানবিকতার ঝান্ডা উড়ানো সব রাষ্ট্র আর সংস্থার চোখের সামনেই। কাগুজে প্রতিবাদ ছাড়া কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বরং আমরা দেখলাম চীন, রাশিয়া আর ভারতে অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষেই। ফিলিস্তিন সমস্যা চলছেই এবং পশ্চিমা শক্তি এখানেও রাজনীতি করছে তাদের মত করে। যে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবী শাসন করছে তার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে গত সপ্তাহে এক শপিংমলে বন্দুকধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে ২০ জন নিহত হয়েছে। এঘটনায় আরও ২৬ জন আহত হয়েছে। এই বন্দুকবাজ ইমিগ্যান্ট বিরোধী ইশতেহার রচনা করে হত্যার মিশনে নেমেছিল।
এই বিশ্ব আজ অন্যরকম। যেন দুর্বৃত্তরা সারা পৃথিবী শাসন করছে। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর অত্যাচার বিশ্বের সর্বত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে উদার ও প্রগতির বিশ্ব আমরা দেখেছিলাম চোখের সামনে সেই পৃথিবী পাল্টে গেল। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী এখন প্রতিস্পর্ধী, জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয় ও বর্ণবিদ্বেষী চরমপন্থীরা মাথা চাড়া দিচ্ছে।
এ এক দুষ্টচক্র। যে বহুত্ব ও বহুমাত্রিকতাকে বলা হত দেশে দেশে রাজনীতিকে মধ্যপন্থার দিকে রাখবে, আন্তর্জাতিক ঘাতপ্রতিঘাত, পৃথিবী জুড়ে চরমপন্থার বিস্তার, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়া ও তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ঢেউ সেই বহুমাত্রিকতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। শান্তির পৃথিবী অশান্তির পৃথিবী হয়ে গেছে। মৃত্যু ওৎ পেতে আছে পদে পদে। কোথাও নিশ্চিন্তে শিশুকে পাড়ায় ছেড়ে দিতে পারছে না মা।
পৃথিবীতে অন্তঃরাষ্ট্রীয় যত সশস্ত্র সংঘাত ঘটছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ম অন্যতম কারণ। ধর্মীয় কারণে হানাহানিতে দক্ষিণ এশিয়া নানা দেশ থেকে এগিয়ে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি একটা ঘৃণার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে ব্যাপকভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই ঘৃণার পরিবেশ বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বার্থে সৃষ্টি করছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার রাজনীতির মূল দর্শন হচ্ছে পাবলিক স্ফিয়ার বা জনমানসে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়।
যেভাবেই হোক না কেন দক্ষিণ এশিয়ার এই তিনটি দেশে ক্রমাগত ঘৃণা আর হিংসার রাজনীতি হাত ধরাধরি চলতে চলতে সহাবস্থান আর সমানাধিকারের ধারণাই লুপ্ত হতে বসেছে। প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদের নতুন ভাষা তৈরি করছে রাষ্ট্র। জনসাধারণের সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিসর সঙ্কুচিত করে ফেলার ভয়ঙ্কর গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতায় আজ আমাদের এই দেশগুলোর শাসনব্যবস্থা আক্রান্ত।
আমরা এক দেশের মানুষ আরেক দেশের আচরণ নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু নিজেদের ভেতরকার অন্যায়টা দেখছি না। যদি ভাবি পৃথিবীটা একটা ঘর, তাহলে আমরা কোথাও না কোথাও জুড়ে আছি প্রত্যেকে, একে অপরের সঙ্গে। আমরা একটা যৌথ পরিবার। সকলে মিলে বাঁচার স্বপ্ন আমাদের। কিন্তু বাস্তব বড় অন্যরকম। এই সুন্দর পৃথিবীতে স্বল্প আয়ুর জীবন নিয়ে এসে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কাদা ছোড়াছুড়ির উপর হইহই করে বেঁচে থাকছি আমরা। এই প্রবণতার ফলে রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে যাচ্ছে। রণনীতি বদলে যাচ্ছে। উন্নয়নের আগে উঠে আসছে উন্মাদনা। আর কেউ না হোক, আমরা অন্তত: ভাবি - নিজেকে বদলাই, চিন্তা চেতনা বদলাই। সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে সরে আসি শান্তির জন্য।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমকেএইচ