ডেঙ্গু: প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অনিমা রায় আমার খুব প্রিয়। শুধু গান করেন না, তিনি গান শেখানও, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক। ব্যক্তিগতভাবেও একটি গানের স্কুল চালান তিনি। এই গুণী নারীর ছোট্ট ছিমছাম সাজানো সংসারে একবার অতিথি হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তার উষ্ণ আতিথেয়তাও ভুলিনি এখনও। তবে তাকে ভালো লাগার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, সবুজের প্রতি তার ভালোবাসা।
তার মত অতটা না হলেও সবুজের প্রতি আমারও অল্প-স্বল্প টান আছে। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে তার ছাদবাগানের ছবি দেখেছি। প্রায় একশ গাছের গোছানো, পরিপাটি বাগান। শত ব্যস্ততার মাঝে অনিমা রায় নিজেই তার বাগানের পরিচর্যা করেন। ইনবক্সে একাধিকবার তার বাগান দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর। যাবো, যাবো করেও যাওয়া হয়নি।
এখন আর যাওয়ার দরকারও নেই। গত ২ আগস্ট অনিমা রায়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম, তার বাগানটি ভবন কর্তৃপক্ষ ধ্বংস করে দিয়েছে। ফ্ল্যাট মালিক হওয়া সত্বেও বাগানটি ধ্বংস করার আগে তার অনুমতি নেয়া তো অনেক দূরের কথা, তাকে জানানোই হয়নি। সন্তানের মমতায় গড়ে তোলা বাগানটি ধ্বংসে অনিমা তার বেদনার কথা লিখেছেন। না দেখা বাগানটির জন্য আমারই যতটা কষ্ট হচ্ছে, অনিমা রায়ের বেদনাটা আমি অনুভব করতে পারছি। উপড়ানো গাছের ছবি দেখে আমার তীব্র রাগ হয়েছে। ক্ষমতা থাকলে আমি সেই ভবনের সভাপতিকে অবশ্যই জেলের ভাত খাওয়াতাম। আইন কী বলে জানি না, কিন্তু এটা অপরাধ।
আমি বুঝতে পারছি, সেই অসংবেদনশীল মানুষটি ডেঙ্গুর আতঙ্কে কাজটি করেছে। আরেকজনের বাগান ধ্বংস করার আগে যে তার সাথে আলোচনা করতে হয়, অন্য কোনো বিকল্প আছে কিনা যাচাই করতে হয়, টাকার গরমে সেই লোক সেটা ভুলে গেছেন বা তিনি টাকা উপার্জনটাই শিখেছেন, ভদ্রতা নয়। তবে আতঙ্কিত সেই অভদ্রলোককে জানানো দরকার ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস মশার সাথে বাগান, ছাদ বাগান বা গাছপালার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি তাই হতো তাহলে গাজীপুর, সুন্দরবন আর বান্দরবানে ডেঙ্গু হতো সবচেয়ে বেশি।
এডিস হলো এলিট নাগরিক মশা। ঢাকা থেকেই তারা সারাদেশে ছড়িয়েছে। এডিস মশার আবাস হলো, জমে থাকা পরিস্কার পানি। সেটা যাতে জমতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পরিচর্যা না করলে বা প্রতিদিন দেখভাল না করলে ছাদ বাগানেও পানি জমতে পারে। নিশ্চিত করতে হবে, পানি যাতে জমতে না পারে। মাথাব্যথার সমাধান কখনোই মাথা কেটে ফেলাই নয়।
এই অসংবেদনশীল, অভদ্রলোকের মত সবাই যদি বাগান বা ছাদ বাগানকেই ডেঙ্গুর জন্য দায়ী মনে করতো, তাহলে এতদিনে ঢাকা গাছশূন্য হয়ে যেতো। অবশ্য ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরুর পর ফেসবুকেই যে কতরকম গুজব ছড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এডিস মশা হাঁটুর ওপর কামড়াতে পারে না, তাই হাঁটু পর্যন্ত নারকেল তেল মাখিয়ে রাখলে মশা কামড়াবে না বা শুক্রবারে একযোগে বেসিনে হারপিক ঢেলে দিলে এডিস ধ্বংস হবে; ভাগ্য ভালো এমন কথা কেউ বিশ্বাস করেনি।
ডেঙ্গুর মত বিপর্যয় মোকাবেলায় আমাদের সবার দরকার সচেতনতা, সতর্কতা, সংবেদনশীলতা; আতঙ্কে গাছ কেটে ফেললে সমাধান হবে না। বলছিলাম সংবেদনশীলতার কথা। ফেসবুক খুললেই এখন হ্যান্ডসাম আর সুন্দরী ঝাড়ুদারদের ছবিতে সয়লাব। আমাদের মন্ত্রী আর মেয়ররা নায়ক-নায়িকাদের সাথে নিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন। এই বিপর্যয়ের সময়ে মানুষ কতটা অসংবেদনশীল হতে পারে, ঝাড়ু দেয়ার এই ছবিগুলো তার প্রমাণ।
বিপর্যয়ের এই সময়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড লোক হাসাবেই শুধু। তবে হাসার মত মানসিকতা এখন নেই কারো। দেখলাম মন্ত্রী যাবেন বলে, ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের সামনে ফাঁকা জায়গায় ফগার মেশিন দিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এখন সময় কাজের। লোক দেখানো বা লোক হাসানোর নয়। এই গরমে স্যুট কোট পরে ফগার মেশিন নিয়ে ছবি তুললে মানুষ হাসবে, মশা মরবে না। মশা মারতে চাই কার্যকর ওষুধ। যেটা এখনও সিটি করপোরেশন আনতে পারেনি। ইনশাল্লাহ, তাদের ওষুধ আসতে আসতে ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সাঈদ খোকন বলে দিলেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে। তার মানে আমাদের আরো একমাস প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কতটা নিয়ন্ত্রণে, পাশের যে কোনো হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেলেই আপনি টের পাবেন। হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্টের রি-অ্যাজেন্ট ফুরিয়ে গেছে; তবুও লম্বা লাইন। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক।
এই সময়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকে খুব মিস করছি। তিনি লন্ডন থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। তবুও তিনি উপস্থিত থাকলে মন্ত্রী আর মেয়ররা পরিস্থিতি এতটা লেজেগোবরে করে ফেলতে পারতো না। বেশ কয়েকদিন ধরেই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটিটা একটু আগে ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে, এই ভয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি দেয়া হচ্ছে না। এরই মধ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষর্থী মারা গেছেন। আজ দেখলাম, এক স্কুলের ছাত্রও মারা গেছে।
আপনি আপনার বাসা বা চারপাশকে নিরাপদ রাখতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অত বড় ক্যাম্পাস নিরাপদে রাখা সত্যি কঠিন। তাই অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া উচিত। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী দেশে থাকলে অনেক আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করতেন। আতঙ্কের রাজনৈতিক ক্ষতির চেয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাটা তার কাছে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো।
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম, 'কারো সর্বনাশ, কারো পৌষ মাস'। এই প্রবণতা এখনও চলছে। ওডোমাস নামে একটা লিকুইড গায়ে মাখলে নাকি মশা কামড়ায় না। কদিন আগেও ওডোমাস বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়, এখন তার দাম নাকি ৫২০ টাকা। দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেল। দেখার কেউ নেই বুঝি।
শুরু করেছিলাম বাগান ধ্বংস করা দিয়ে। বাগান বা গাছ বা প্রকৃতি আমাদের শত্রু নয়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করলে সে তার মত সব ব্যবস্থা নেয়। ব্যাঙ বা গাপ্পি মাছ মশার লার্ভা ধ্বংস করে। কিন্তু আমরা মশা ধ্বংস করতে না পারলেও মশার শত্রুদের ধ্বংস করেছি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই এডিসের বংশবিস্তার হয়েছে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। আমরা প্রকৃতিকে বিরক্ত করছি, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। ডেঙ্গু আসলে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ।
এইচআর/পিআর