ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে মানা!
আগেকার সময়ে বিদেশ ফেরত সাধারণ ছেলেদের নিয়ে এক ধরনের ট্যাবু ছিল। এখনো যে নেই তা নয়। কারণ ছেলে সেখানে আর একটা বিয়ে করেছেন কি না বা কোনো ধরনের রোগব্যাধি বিশেষ করে যৌনরোগ রয়েছে কিনা তা নিয়ে পাত্রীপক্ষ ব্যাপক সন্দিহান থাকতো।
কথাটা যে প্রসঙ্গে বলা। সামনে পবিত্র ঈদুল আজহা। যারা জীবিকার টানে শহরে বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগই চান এ সময় গ্রামের বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। রোজার ঈদের চেয়ে এই ঈদে মানুষ ঢাকা ছাড়েন বেশি। কারণ কোরবানির একটা বিষয় থাকে। সংবাদপত্রের ভাষায় আমরা যেটা বলে থাকি নাড়ির টানে বা শেকড়ের টানে বাড়ি ফেরা। কিন্তু এবার সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘাতক ‘ডেঙ্গু’।
রাষ্ট্রের পক্ষে সেটিকে মহামারী বলতে নারাজ। কিন্তু বর্ধিত কলেবরে ভনভন ঘুরতে ঘুরতে ‘মহামারি’ আকারেই ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। জেলায় জেলায় হাসপাতালগুলোতে আলাদা ইউনিট খোলা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হলো, সেসব জেলার সিভিল সার্জনরা বলছেন, ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বা জ্বর নিয়ে কেউ যেন ‘আল্লার ওয়াস্তে’ বাড়ি না যায়। কেনো এই কথা? মানুষ কি তাহলে খুশি ও আনন্দের ঈদ উদযাপন করবে না?
বেসরকারিভাবে হিসাব নিলে দেখা যাবে প্রায় প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু রোগীর অস্তিত্ব রয়েছে। সেকারণে পুরো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এমনকি চিকিৎসক সমাজও রয়েছে আতঙ্কের মধ্যে। কারণ কয়েকজন চিকিৎসকও ইতোমধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন। খেয়াল করুন সে কারণে কয়েকটি জেলার সিভিল সার্জন থেকে শুরু করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘আল্লার ওয়াস্তে’ ঢাকা ছাড়বেন না। কতোটা অসহায় হলে এই শব্দটি প্রকাশ করা হয়।
সত্যিইতো এতোটা অসহায় অবস্থা আমাদের। কারণ কে কোথায় কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সবশেষ আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত মশা মারার মতো তুচ্ছ কাজেও (যদিও মশা না মারার কারণে সেটি এখন আর তুচ্ছ কাজ নেই) প্রধানমন্ত্রী না বললে কাজ হয় না। আদালতকে পর্যন্ত এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে চিকিৎসকরা যে ঢাকা থেকে বাড়ি না যাওয়ার জন্য বলছেন তার একটা যৌক্তিক কারণ কিন্তু রয়েছে। এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে যতো রোগী শনাক্ত করা হয়েছে তার আশিভাগেরই বেশি ঢাকা থেকে যাওয়া রোগী। সে কারণে ওই বিদেশ থেকে আসা পাত্রের মতো জেলায় জেলায় থাকা মানুষজন থেকে শুরু করে চিকিৎসকরাও আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতোমধ্যে আগাম বাস বা ট্রেনের টিকিট বিক্রির সময় যা দেখলাম তা হচ্ছে দীর্ঘ লাইন।
টিকিট কাটলেই বাড়ি যেতে হবে তা নয়, সময় আরো আছে। কিন্তু সত্যি যদি এর মধ্যে ডেঙ্গু আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আর এই মানুষগুলো গিয়ে সেটিকে সারাদেশের জন্য হুমকি হিসেবে গড়ে তুলে তাহলে কী হবে ভাবা যায়? ভাবার উপায় নেই বা ভাবতে পারছি না এই কারণে যে, মশা মারা নিয়ে যে পরিমাণ ‘ধাক্কাধাক্কি’ হচ্ছে তাতে মনে হয় এই দেশের মানুষ সহসা ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাবেন না। অথচ চাইলে এতো এতো এমপি, সারাদেশে এতো এতো নেতাকর্মী অন্তত জনস্বার্থে এই কাজটিতে উদ্যোগী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তবে কেউ উদ্যোগী হয়ে কাজ শুরু করেছে এমনটি শোনা যায়নি।
এই যে ঢাকার কথাই যদি ধরি, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যদি কমিশনাররা সজাগ থাকতেন, কাজ করতেন তাহলেতো এতোগুলো মানুষের মৃত্যু হতো না। এতো এতো মানুষ আতঙ্কে, টেনশনে ঘুম নষ্ট করতেন না। যেটি করলে জনগণের ভালো হবে সেটি করতে কেনো এতো সময়ক্ষেপণ? স্বাভাভিকভাবে মৃত্যুর নিশ্চয়তাও কি এদেশে পাওয়া যাবে না। এই দেশে জন্মে কি এতোটাই ভুল করেছি। কবে আসবে আমাদের সেই নেতা, সেই দিকনির্দেশনা কার কাছ থেকে পাওয়া যাবো যিনি আম জনতার কথা ভাববেন?
এখনকার নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ আর জনগণকে ধমক দিতেই যেন ওস্তাদ। জনতার সুখ দুঃখে হাসি আনন্দে কাছে থাকার মুরোদ নেই। সবাই যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহারের মতো একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি আসবেন যিনি শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশ থেকে মশা বিতাড়ন করবেন। যিনি বলবেন, আতঙ্ক নিয়ে নয়, ঈদ উদযাপন হবে খুশি নিয়ে। বাড়ি যাবেন নাড়ির টানে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/পিআর