ভিআইপি সংস্কৃতি ও তিতাস ঘোষের করুণ মৃত্যু
দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার আছে, আছে শক্ত পোক্ত একটি রাজনৈতিক নেতৃত্বও যার অগ্রভাগে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু জনগণকে প্রতিনিয়তই এক পরাক্রমশালী আমলাতন্ত্রকে মোকাবেলা করতে হয় যার কুশীলবরা প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার কথা। কাগজ কলম এক জিনিস, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্তবে জনগণই উল্টো তাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছে।
এই ত্যাগ স্বীকার কোন সাধারণ কোন ছাড় নয়, জীবনকেই বিলিয়ে দিতে হচ্ছে। মানুষের জীবনের চেয়ে যে অসাধারণ বা তথাকথিত ভিআইপিদের চলাচল বড় তার এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল সম্প্রতি। গত ২৫ জুলাই রাতে মাদারীপুর কাঠালবাড়ি ফেরিঘাটে স্কুলছাত্র তিতাসকে নিয়ে নদী পার হতে অ্যাম্বুল্যান্সে অপেক্ষা করছিলেন মা। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায়, ফেরি ছাড়েনা। ফেরি ম্যানেজারের পায়ে ধরেও মা তার অসুস্থ সন্তানকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য সময়মত নদী পার হতে পারেননি। সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি বসে থাকায় ঘাটে আটকে পড়া অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর গুরুতর আহত স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষ মারা যায়।
এখন তদন্ত কমিটি হচ্ছে, কে ভিআইপি আর কে নয়, সেই পর্যবেক্ষণও এসেছে হাইকোর্ট থেকে। কিন্তু যারা ‘অ-সাধারণ’ হবার সুবিধাটি পূর্ণমাত্রায় ভোগ করে চলেছেন, তারা অতঃপর ‘সাধারণ’-এ উপনীত হবেন – এই আশা কি করছি আমরা? না করাই ভাল। আমরা জানি এই ভিআইপি সংস্কৃতির কোন অবসান কখনও হবে না।
আমলারা, এক শ্রেণির ক্ষমতাবান রাজনীতিক, বহু দিন ধরে ভুলেই বসে আছেন যে তাদের কাজ মানুষের জন্য। ভুলেছেন বলেই যানজটের চাপে যখন সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে, অসুস্থ ব্যক্তির প্রাণসংশয় হয়, তখন তারা ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে গন্তব্যে ছোটেন। অথচ এই মানুষগুলির স্বার্থ রক্ষাই নাকি তাদের একমাত্র দায়িত্ব।
বাস্তবে সেই দায়িত্ব পালনের আগ্রহ অপেক্ষা তাদের পক্ষ হতে ক্ষমতার আস্ফালন চোখে পড়ে অনেক বেশি। তাদের গাড়িতে লালবাতি ও নানা ধরনের সাইরেন আছে, আগে পিছে পেয়াদা আছে। আর এগুলো সেই আস্ফালনেরই নামান্তর মাত্র। এবং বিভাজনেরও বটে। বিভাজন পদাধিকারের, ক্ষমতারও। যে সরকারি কর্মচারী বিসিএস দিয়ে শপথ নেন যে তিনি কাজ করার সময় মানুষকেই সব কিছুর উপরে রাখবেন, সেই তিনিই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মানুষকে নিচে ভাবতে শুরু করেন।
তিতাসের ঘটনা আমাদের নাড়া দিয়েছে। কিন্তু ফেরিঘাটে এমন অসংখ্য ঘটনা নিয়মিত ঘটে। এদেশে কত ভিআইপির জন্য শত শত মানুষকে কষ্ট দিয়েও ট্রেন ছাড়েনা, প্লেন ছাড়েনা সেসব লিখতে গেলে সব প্রিন্টিং প্রেস মিলেও তা ছেপে শেষ করতে পারবে না। আমরা এমনিতে কথায় কথায় বলি আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মানুষ কেবল বুঝতে শিখে এদেশে ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকে তারা সমানের চেয়েও বেশি সমান।
তারা রাস্তায় রাজা, তারা যেকোন সেবা প্রতিষ্ঠানে সবার আগে সেবা প্রাপ্য, তারা যেকোন সুবিধা সবার আগে ভোগ করবেন। ‘ভিআইপি’ সংস্কৃতি মানেই হল এরা সাধারণ নাগরিক হতে ভিন্ন এক স্বতন্ত্র শ্রেণি। এই আমলাতান্ত্রিক প্রবণতাটি চরম ক্ষতিকর, সর্বনাশের মূল। এটি এক ধরনের অসুস্থতা এবং এই ভিআইপি সংস্কৃতির মাধ্যমেই সমাজ ব্যাধিগ্রস্ত হয়।
ভিআইপি সংস্কৃতির মূল দর্শন হলো রাষ্ট্রক্ষমতা যারা হাতে পেয়েছেন তারা সেই ক্ষমতা নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে লজ্জিত নন। আইনের শাসন, নিয়মের আনুগত্য হতে তাদের মুক্তি মিলেছে এটাই তাদের বিশ্বাস। এরা এমন যে, টোল প্লাজায় রোড ট্যাক্স চাইলে, ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য আটকালে তারা পুলিশের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। গণমাধ্যম সেই ছবি তুলতে গেলে তারা দেখে নেয়ার হুমকি দেন। নাগরিক জীবনের নানা পরিসরে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও তাদের অনুচরেরা, আমলারা যথেচ্ছ নিয়ম ভাঙেন। দেশবাসীকে তারা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখেছেন। এই ভয়ানক ভিআইপি সংস্কৃতি ধরে রেখে সুশাসনের বুলি আওড়ানো আসলে প্রতারণার নামান্তর।
এই ভিআইপি সংস্কৃতি সমাজকে বিভাজিত করে রাখার এক আগ্রাসী তৎপরতা। একটি জড় বস্তুকে অপসারিত করবার কাজটি সহজ। কিন্তু হাতে ক্ষমতা পেলে বা সামাজিক মর্যাদায় এক ধাপ উঠলে নিজেকে ‘বিশেষ’ ভাববার প্রবণতার অপসারণ সহজ না। এই প্রবণতা হতেই সাধারণ মানুষকে অপদস্থ করবার, তাদের নিকট হতে পবিত্র দূরত্ব বজায় রাখবার মোক্ষম ইচ্ছাটি জন্ম নেয়।
বলছিলাম রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে আমলা শ্রেণি কি করে এমনটা করে। অনেক সমালোচনার পরও রাজনীতিকরাই জনগণের জীবনের গতিপথ ঠিক করেন। তাই রাজনীতির কাছেই আমাদের আবেদন নিবেদন। তিতাস ঘোষের করুণ মৃত্যু আমাদের বিবেককে জাগ্রত করুক। প্রধানমন্ত্রী একটা ঘোষণা দেন – বাংলাদেশের জনগণই ভিআইপি, আর কেউ নয়।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম