ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ডেঙ্গু : গুজব হলেই ভাল হতো

অঘোর মন্ডল | প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ২৮ জুলাই ২০১৯

মুঠোফোনের ক্ষুদে বার্তাগুলো বড় হচ্ছে। কেউ লিখেছিলেন; মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেলাম। মেয়েটার ডেঙ্গু ধরা পড়েছে! কোন এক সহকর্মী লিখেছিলেন, গেলো সাত দিন ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে! কেউ বলছেন, অবশেষে ডেঙ্গু আক্রান্ত। কিন্তু হাসপাতালে কোন বিছানা ফাঁকা নেই! কেউ লিখেছেন, হাসপাতালে দর্শণার্থীর বেঞ্চ এখন ডেঙ্গু রোগীর বিছানা!

ছোট ছোট এই বাক্যগুলো আরো হৃদয়স্পর্শী এবং বড় হয়ে জায়গা পাচ্ছে পরিচিত মানুষগুলোর ফেসবুক ওয়ালে। সেখানে কত লোকের নিঃশব্দে আচম্বিত চলে যাওয়ার কথা। পেশাগত কারণে অনেক পরিচিত লোকও আছেন ঐ তালিকায়। যারা হারিয়েছেন আপনজনকে। স্বজন হারা পরিচিত মানুষের মিছিলটাও যেন বড় হচ্ছে!

সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিন। যারা দিন রাত চেষ্টা আর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রোগাক্রান্ত মানুষের জীবন বাঁচাতে। তাঁদেরও অনেকের প্রাণ কেড়ে নিল ডেঙ্গু! সিলেটের সিভিল সার্জনের মৃত্যুকে কী বলবেন! অন্যদের চিকিৎসা দিতে, সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেই বুঝতে পারলেন না তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত। তাঁর এক সহকর্মী যখন তাঁকে বোঝালেন, ততক্ষণে সব শেষ!

কোন নোটিশ-টোটিশ না দিয়ে জীবন থেকে চিরদিনের ছুটি নিয়ে গেলেন ডাক্তার সাহেব! কিন্তু এই মানুষগুলোর হারিয়ে যাওয়া, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা সবই কী ‘গুজব’! যদি তাই হয়, তাহলে এরা কেউ মরেননি। কেউ হারিয়ে যাননি। কেউ হাসপাতালে ভর্তি হননি। হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান এদের কারোই বাড়তি কোন চাপ নিতে হচ্ছে না। নিয়মমাফিক হাসপাতালে আসছেন। যাচ্ছেন। মাঝখানে রোগী দেখার কাজটা করে যাচ্ছেন!

আর সাংবাদিকরা অহেতুক ক্যামেরা-বুম নিয়ে হাসপাতালগুলোতে ছোটাছুটি করছেন। লাইভ দিচ্ছেন। কেউ পরদিনের পত্রিকায় বড় বড় হেড লাইন করছেন; ‘ডেঙ্গু রোগী সামাল দিতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে’। এর সবকিছুই অসত্য। সবই তথ্যবিভ্রাট! যে কারণে ঢাকা দক্ষিণের নগরপিতা বলেছেন; ‘এর সবই গুজব। ছেলেধরা গুজব আর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা একই সুত্রে গাঁথা।’

হুমকি দিয়ে বলেছেন; ‘ এদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। যারা জীবন হারিয়েছেন তাদের সাথে এ কেমন রসিকতা নগরপিতার! খণ্ডিত ঢাকা নয়, অবিভক্ত ঢাকার নগরপিতা ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ মেয়র হিসেবে তাঁর মেয়াদকাল ঘেঁটে তো এরকম দাম্ভিক উক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর ভেতর তো একটা বনেদীয়ানা-উচ্চমার্গীয় ব্যাপার ছিল। যে কারণে তাঁর কথায় আস্থা রেখে ঢাকার মানুষ ভোট দিয়ে প্রথম নির্বাচিত নগরপিতা বানিয়েছিলেন তাঁকে।

আভিজাত্য, বনেদিয়ানা, উচ্চমার্গীয় ব্যাপারগুলো ছিল তাঁর কথায়। কিন্তু সামনাসামনি, কিংবা নগরভবনে তাঁকে মনে হতো পাশের বাড়ির অভিভাবক। বাবার রেখে যাওয়া সুনাম আর অর্জন যার পুঁজি ছিল তিনি মানে বর্তমান মেয়রের সামনে তো সেটাকে কাজে লাগিয়ে যুবরাজ থেকে সম্রাটে পরিণত হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব! ডেঙ্গু সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে যিনি গুজব সৃষ্টিকারী খুঁজছেন, আগামীতে তাঁর ভাল উদ্যোগে ক’জনকে পাশে পাবেন!

প্রশ্নটা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন মৃদু ভর্ৎসনার সুরেই বলেছেন;‘দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলবেন না।’ আওয়ামী লীগের জোট সঙ্গী সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন কোন রাখঢাক না রেখেই বলেছেন’ ‘দুর্নীতি ঢাকতে ডেঙ্গুকে গুজব বলছেন!’ ডেঙ্গু নিয়ে রসিকতায় সবার চেয়ে একধাপ এগিয়ে আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি ডেঙ্গু রোগের জীবাণু বাহিত মশা এডিশ মশার প্রজন্নন ক্ষমতার কথা বলতে গিয়ে টেনে এনেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের। তুলনা করেছেন এডিশ মশা আর রোহিঙ্গাদের প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই ডেঙ্গুর প্রকপ বাড়ছে!

ডেঙ্গু নামক স্টেশনে কত মানুষের জীবন ট্রেন থেমে যাচ্ছে প্রতিদিন। কত মানুষকে নেমে যেতে হচ্ছে সেই ট্রেন থেকে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে ছুটেও জীবনের সীমারেখার মধ্যে আটকে থাকতে পারছেন না। স্মৃতি হয়ে চলে যাচ্ছেন জীবনের ওপারে। আর তাদের মৃত্যু নিয়ে দায়িত্বশীলরা যখন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে বলছেন; সবই গুজব! তখন মনে হয়; গুজব যদি সত্যি হতো! কত মানুষের আহাজারী শুনতে হতো না। কত মানুষের ওয়ালে পড়তে হতো না হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সেই কথাগুলো!

ডেঙ্গু নিয়ে গুজব, মেয়র-মন্ত্রীদের মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে কোন এক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হয়তো অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করছেন সক্রেটিসের সেই অমর বাক্য; ‘আমরা যে যার রাস্তায়। আমি মৃত্যুর দিকে। আপনি বাঁচার দিকে। কোন রাস্তাটা ভাল একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।’

কে কী ভাবছেন জানি না। তবে এইটুকু ভাবি, গুজবটা সত্যি না হলেই ভাল হতো।

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন