সরকার কি শুধুই প্রধানমন্ত্রী?
সৈয়দ আশরাফ সাহেব যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমার একটি কথাই মনে হয়েছিল আওয়ামী লীগের এই প্রজন্ম শেষে পরের প্রজন্মের নেতারাও কি তাঁদের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও দুর্নীতি বিরোধী কঠোর মনোভাব ধারণ করবেন? ওঁরা কি পেরেছেন বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে আসা পরবর্তী নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বা চার নেতার আদর্শ সঠিকভাবে প্রোথিত করতে? এজন্যই কি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের চর্চা অবধারিত? এটিই কি গান্ধী পরিবারের নেতৃত্ব বঞ্চিত ভারতের উদারপন্থী দল কংগ্রেসের দেউলিয়া হওয়ার কারণ নয়?
আমার সংশয় যে কতটা সত্য, তা আমি প্রতিদিন সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের দ্বিমুখী আচরণেই অনুভব করি। দলটির বর্ষীয়ান নেতারা পর্যন্ত যে কোনো জাতীয় ইস্যুতে সিদ্ধান্ত দিতে এতো সংশয়ান্বিত কেন? তাঁরা সবাই দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সাথে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেছেন, তারাই দলটির পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এখনো কি তারা ঠিক জানেন না তাঁদের সরকার কি চায়, কিভাবে চায়? তাঁরাই যদি নিজেদের কাজে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে না পারেন, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃবৃন্দ কি করে পারবেন?
বর্তমানে দেশে সবচে' বেশি আলোচিত বিষয় হলো অরক্ষিত ব্যক্তি নিরাপত্তা। দেশে এতো এতো আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ও খুন-ধর্ষণ হয়, শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে আর প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলেই সেটির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সরকার কি জানে না প্রতিটি অপরাধীরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রাপ্য যেন এই অপকর্মের পুনরাবৃত্তি না হয়? প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ত্বরিত ও সঠিক বিচার পাওয়া প্রয়োজন যেন সে রাষ্ট্রের আইন ও শাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
ক্রমবর্ধমান সামাজিক অপরাধের মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কি দেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস করতে নতুন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনিক সমস্যা সমাধানের নতুন ও উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে পেতে গবেষণা করতে? সেটি কি মন্ত্রীদেরই বলার কথা নয়? উল্টো তাদের লাগামহীন বক্তব্য পরিস্থিতি জটিল করেছে।
দেশে চলছে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি দিয়ে খুনের মহড়া। এই রকম একটি অমানবিক ভয়ঙ্কর সমস্যার সঠিক ও তাৎক্ষণিক সমাধান না দিয়ে শুধু বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র বলেই দায় সারছেন অনেক কর্তা-ব্যক্তি। ষড়যন্ত্র হতেই পারে, কিন্তু সমাধান সরকারকেই করতে হবে; একটি প্রাণও যেন না ঝরে সেটা তো আপনাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে। এখনো কি বাকিরা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের জন্য বসে আছেন?
ফেনীর নুসরাতের ঘটনায় স্থানীয় এমপির সংশ্লিষ্টতা যখন জনমনে ক্ষোভ তৈরি করছিলো, দায়িত্বে থাকা নিশ্চুপ অনেককে বাঁচিয়েছেন শেখ হাসিনা। বরগুনার রিফাত হত্যার ভাইরাল ভিডিও ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও সরকারকে স্বস্তি দিচ্ছে না স্থানীয় এমপিদের দৌরাত্ম্য। বিশেষ কোনো সচিবের আগ্রহে শাহরিয়ার মঞ্জুরকে দেয়া তাৎক্ষণিক কর্মস্থল ত্যাগের আদেশে যখন দেশে উত্তেজনা এবং প্রধানমন্ত্রী নরওয়ে সফরে, তখনও কি কেউ জানেন না কি করতে হবে?
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সবুজ জার্সির গায়ে লালের পরিবর্তে কালো রঙের বিরুদ্ধে তারুণ্যের প্রতিবাদে কেউ কেউ বিরক্ত হলেন। প্রজন্ম পতাকা ভালোবাসে, শহীদদের রক্তের রং স্মরণ করে; এটা দোষের নয়, বরং গৌরবের! সেটাও প্রধানমন্ত্রীকেই বুঝতে হলো! অধ্যাপক এবিএম ফারুখের গবেষণায় পাস্তুরিত দুধে এন্টিবায়োটিক পাওয়াকে অনেকে দেখলেন মিল্কভিটার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে। বিএসটিআই বললেই কি আমাদেরকে বুদ্ধি-বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে প্রতিযোগী ব্যবসায়ী ভাবতে হবে? ঠিক দু'দিন পর মিল্কভিটায় রাসায়নিক দুধ সরবরাহের অপরাধে পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করলো। সেটি দেখা তাহলে কার দায়িত্ব ছিল?
প্রিয়া সাহার বক্তব্যের প্রতিবাদে যখন দেশ ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংকটে, দায়িত্বপ্রাপ্তরা বেছে নিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠদের শান্ত করে সংখ্যালঘিষ্টদের কোনঠাসা করার সহজ উপায়। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার উস্কানির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক নীতি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বৈকি। প্রধানমন্ত্রীই যদি বলবেন কি করতে হবে, তাহলে আর আগে বাড়িয়ে ভুল করা কেন?
সর্বশেষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম তিনদিন বন্ধ থাকা ও একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যার সমাধান আসছে না প্রধানমন্ত্রী দেশে নেই বলে! এডিস মশার সাথে রোহিঙ্গাদের তুলনা না করে বরং হাসপাতাল গুলো ঘুরে দেখা বা অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করাটাই বেশি জরুরি ছিল। না হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পই একটু ঘুরে দেখতেন; বক্তব্যের সত্যতা যাচাই হতো। জানিনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ও প্রধানমন্ত্রী ফেরার অপেক্ষায় কিনা।
এতো এতো মন্ত্রণালয় কি সব অর্থহীন তাহলে? খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর কাজে আস্থা রাখেন দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ। অন্যান্যদের কাজে জনগণের আস্থা কেমন সেটাও যদি পরিমাপ করা যেত, তাহলে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর কাজের চাপটা বোঝা যেত। একক ব্যক্তি নির্ভর সরকার বিশ্বস্ত হলেও দুর্বল। ব্যক্তির সকল সিদ্ধান্তের দায় তার জন্য হুমকি স্বরূপ; তাতে অন্যরা নির্দোষ থেকে যায়!
সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে ক্ষমতার সাথে সাথে দায়িত্বেরও সম-বন্টন হয়েছে এবং জনগণ তাদের কষ্টার্জিত অর্থের করের টাকায় সর্বোচ্চ সেবা পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী একাই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নন; সরকারের প্রতিটি অংশকে সেই দায়বদ্ধতার ভাগ নিতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কর্মদক্ষতা এবং আন্তরিকতাও মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকুক এবং সে অনুযায়ী নিয়মিত পরিবর্তন আসুক, নতুবা পদ-পদবি দায়িত্বের পরিবর্তে ক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এমকেএইচ