ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বানভাসিদের পাশে কেউ নেই!

শান্তনু চৌধুরী | প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ২৫ জুলাই ২০১৯

‘বন্যা। সারা দেশ ভাসিয়া গিয়াছে। গ্রামকে গ্রাম ধু ধু করিতেছে। বিস্তীর্ণ জলরাশির কোথাও কোথাও ঘরের চাল ও বাঁশের ঝাড়ে ডগা জাগাইয়া লোকালয়ের অস্তিত্ব ঘোষণা করিতেছে। এই বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে মৃত্তিকার গৌরব ঘোষণা করিতেছে শুধু কোম্পানির উঁচু রেল-সড়ক। এই রেল-সড়কই হইয়াছে বন্যা-বিতাড়িত পল্লীবাসীর একমাত্র আশ্রয়স্থল। যারা রেল-সড়কের মাটিতে জায়গা পায় নাই, তারা কলা গাছের ভেলা তৈরি করিয়া সপরিবারে সেই ভেলায় ভাসিতেছে। দুপাশের দু-দশখানা গ্রামের সমস্ত লোক আসিয়া এই সড়কের উপর আশ্রয় লইয়াছে। রেল সড়কে তিল ধারণের স্থান নাই। মানুষ, পশু, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া গা ঘেষাঘেষি করিয়া সড়কের উপর ভিড় করিয়া নৈসর্গিক বিপদের সাম্য-সাধনা-ক্ষমতা ঘোষণা করিতেছে।’

বন্যার ভয়াবহতা বোঝাতে আবুল মনসুর আহমেদের এই বর্ণনার কোনো তুলনা হয় না। এবারের বন্যায় সেই ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। কিন্তু যেটি সবচেয়ে অবাক করার বিষয় তা হলো রিলিফ ওয়ার্ক বা বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। নিদেনপক্ষে ফেসবুকে ছবি প্রকাশের জন্য হলেও কেউ ত্রাণ দিয়েছে তেমনটা চোখে পড়েনি।

এর কারণ কী? ভোটের বছর নয় বলে, নাকি ভোটের কোনো ব্যাপার নেই বলে। অথবা এমন হতে পারে ঢাকায় বসে জননেতারা বন্যার ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না। কোনো কোনো নেতা নাকি এমনও বলার চেষ্টা করেছেন, এবারের বন্যায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কথাটা অবশ্য তারা বলছেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে। অথচ যারা নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখেন বা এলাকার খোঁজ খবর রাখেন তারাই জানেন এবারের বন্যা কতোটা ভয়াবহ। এবং দুঃসংবাদ হচ্ছে, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানাচ্ছে, আগামীতে আরো ভয়াবহ বন্যা অপেক্ষা করছে। কয়েকটি এলাকার কথা বললেই বোঝা যাবে এবারের বন্যা পরিস্থিতি কতোটা দুর্ভোগ ডেকে এনেছে মানুষের মাঝে।

গাইবান্ধার এবারের বন্যা ত্রিশ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। দিশেহারা বানভাসিরা। ত্রাণ বলতে চাল, চিড়া আর গুড়। তাও আবার সবার ভাগ্যে জোটেনি। তিস্তা ও ধরলাসহ অন্যন্য নদ-নদীর পানি কমলেও বন্যা কবলিত এসব এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পানির চাপে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি সবকটি পয়েন্টে পানি ছিল বিপৎসীমার ওপরে। নষ্ট হয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি। বেশ কয়েকদিন বান্দরবানের সঙ্গে বন্ধ ছিল সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ। এবারো পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মহাসড়কগুলো তেমন একটা ক্ষতি না হলেও আঞ্চলিক সড়কগুলো বন্যায় ভেঙে যাওয়ায় সামনের ঈদযাত্রায়ও পোহাতে হবে ভোগান্তি।

রেলসড়কে পানি উঠে অনেক জায়গায় আটকে ছিল ট্রেন। কোথাও কোথাও ট্রেন চলেনি। এখনো নতুন করে গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন পানিতে নিমজ্জিত থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কাঁচা ঘরবাড়ি। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের তাড়াই এলাকায় বাঁধ ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ১০টি গ্রাম। পানিবন্দি ১১১ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। এমন তথ্য অনেক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বে। জুলাইয়ের শুরু থেকে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বৃষ্টি হয়। এর ফলে কিন্তু চীন, ভারত ও নেপালে বন্যা হয়েছে। এই বন্যার পানি নেমে বঙ্গোপসাগরে পড়ার প্রধান পথ বাংলাদেশের নদীগুলো। মূলত ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও যমুনা দিয়ে এই পানি নেমে যায়। এমনিতে পানির ব্যাপক চাপ, এর মধ্যে আমাদের দেশের অধিকাংশ নদ-নদী ডেজিং হয় না বছরের পর বছর।

এর ফলাফল দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। জাগো নিউজ মাউশির তথ্য দিয়ে বলছে, দেশের ১৪ জেলায় বন্যায় দুই হাজার ১৪৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পর্যায়ের ৯৩২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে এক হাজার ২২৭টি। চর অঞ্চল বা নদীর কিনারে থাকা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় ঘরহারা মানুষ গবাদি পশু নিয়ে বাঁধ, রাস্তাঘাট, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নিয়েছেন। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে কলেরা, ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

এতোসব দুর্ভোগ আর ঠিকে থাকার সংগ্রামের পরও যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে বেশিরভাগ জায়গায় ঠিকমতো ত্রাণ পৌঁছায়নি। সেটি সরকারের পক্ষ থেকে হোক, স্বেচ্ছাসেবীদের পক্ষ থেকে হোক বা স্থানীয় ধনী শ্রেণির পক্ষ থেকে হোক। সরকারিভাবে যেসব ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা অপ্রতুল। এর ওপর আবার স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভাগভাটোয়ারা রয়েছে। সে কারণে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অনেকে অভিযোগ করেছেন, ঠিকমতো খাবার না পাওয়ার। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে মানবেতর দিন যাপন করছেন তারা।

এবার কেনো এমন হচ্ছে? অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন বন্যা কবলিত মানুষের পাশে নেতা-কর্মীদের দাঁড়াতে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একই নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় পার্টিও। কিন্তু কই কেউতো এগিয়ে এলো না। এর কারণ কী ভোটের রাজনীতি। নাকি একের পর এক এতো এতো অঘটন জন্ম নিচ্ছে মানুষের মন সত্যিকার অর্থে বিক্ষিপ্ত। বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সেই ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।

অন্যান্য সময় দেখা গেছে, বন্যার্তদের সহযোগিতার তোড়জোড়, সবাই অর্থ, খাবার বা নগদ সহায়তা নিয়ে ছুটে যেতেন। অনেকে লোকদেখানো হলেও ত্রাণ বিতরণের ছবি ফেসবুকে আপলোড দিতেন। কিন্তু এবারের চিত্রটি কেনো যেন ভিন্ন। তাহলে কী বানভাসি মানুষের পাশে কেউ থাকবে না? কৃষিমন্ত্রী যদিও বলেছেন, প্রতিটি জেলার উঁচু স্থানে আমনের চারা তৈরির জন্য বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় দ্রুত ও পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

এই সাধারণ মানুষগুলো যদি না বাঁচে তবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখবে কারা। তাদের শ্রমে ঘামেতো সচল থাকে একটি দেশ। এই যে প্রতিবছর বন্যা আসবে সেটি জানা কথা। ক্ষতি কম হোক বা বেশি হোক এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা তারা বাকি সময়গুলো কী করে? কেনো আগাম ব্যবস্থা নেয়া হয় না? কেনো পানি উন্নয়ন বোর্ড এর দেয়া বাঁধ দিতে না দিতেই ভেঙে যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এর পেছনে রয়েছে দুর্নীতির মহোৎসব আর কাজের গাফিলতি। মাটি দেয়ার বদলে বাঁধ দেয়া হয় বালি দিয়ে, পাকা রাস্তায় যে পরিমাণ ইট, সুরকি বা বিটুমিন দেয়ার কথা তা নেই।

প্রকৃতপক্ষে সরকারের এতো এতো অর্জন সব ধুলোয় মিশে যায় শুধু দুর্নীতির কারণে। নইলে বরাদ্দ কিন্তু কম আসে না। এই যে বন্যা বা বন্যা পরবর্তী বরাদ্দ আসবে তাতেও চলবে হরিলুট। নানা বাহানায় টাকা আসবে, পকেটে ঢুকবে। বানভাসি মানুষের হাহাকার কেউ শুনবে না। আবার তারা কোনো রকমে মাথা উঁচু করার বাসনায় নিজের সর্বস্ব দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করবে। আর তার নামে আসা বরাদ্দ কার গোলা ভরবে সে নিজেই জানবে না কোনোদিন।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন