রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা একটি নিরাময়- অযোগ্য ভয়ঙ্কর রোগ
বাংলাদেশে জন্মে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন না এমন মানুষ সম্ভবতঃ পাওয়া যাবে না, যদিও হলপ করে একথা আমরা বলতে পারবো না যে, এ মাটিতে যাদের জন্ম তাদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। নাহলে, ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের পক্ষে বাঙালি নিধনযজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন তারা বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন এমন প্রমাণতো আমরা পাই না।
এমনকি স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশকে যারা সমস্যাক্রান্ত করে নিজেদের আখের গোছানোর নিমিত্তে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছেন তাদেরও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ পোষণের যথেষ্ট কারণ আছে। আগেভাগেই বলে রাখা ভালো যে, পৃথিবীর নব-বাস্তবতায় দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলি এতোটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, এক দেশে জন্ম নিয়ে আরেক দেশে বসবাস কিংবা কর্মোপলক্ষে দীর্ঘসময় থাকা অথবা নতুন কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেই যে দেশটিতে জন্ম সে দেশটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয় না, বরং দিনের পর দিন দেশে অবস্থানরত স্বজনদের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়াও এখন দেশপ্রেমের অংশ।
বাংলাদেশকে নিয়ে যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র অথবা শত্রুতা মুক্তিযুদ্ধকালে শুরু হয়েছিল তা এখনও যে শেষ হয়নি তার ভূরি ভূরি প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু আলোচনা যেহেতু এখনকার ঘটনাবলী নিয়ে সেহেতু এই সময়ের কিছু উদাহরণ দিয়েই আলোচনা শেষ করতে চাই। স্বীকার করি বা না করি বাংলাদেশের রাজনীতি আর আগের অবস্থানে নেই। দু’দু’টি সামরিক সরকারের যথেচ্ছাচারে জন্ম নেয়া দু’দু’টি রাজনৈতিক দলের একটি নিজেদের প্রবল গণভিত্তিকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে এখন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আর অপরটি এরশাদ-বিয়োগের পর নিজেরা কী করবে তাই নিয়ে বিভ্রান্ত। কিন্তু এই সামরিক শাসনের কালে বাংলাদেশে ফিরে আসা যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিটি গত এক দশকে অনেকখানি শক্তিক্ষয় করেও এখন আবার বিভিন্ন বেশে, নানা ছুতোয় রাজনৈতিক তৎপরতা (পড়ুন অপতৎরপতা) চালিয়ে যাচ্ছে।
অনেক বিজ্ঞজনই এই বিতর্ক করতে পারেন যে, দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা চলার সুযোগ থাকলে অপতৎপরতার সুযোগ কমে যায়। প্রশ্ন হলো কোন সুযোগ? একটু ক্লিশে শোনালেও আমাদের একথা মানতেই হবে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা বলতে আমরা এযাবত শুধু ভাঙচুর কিংবা জ্বালাও-পোড়াও ই বুঝেছি। আমরা একথা কেউ বুঝতে বা বোঝাতে পারিনি যে, এই দেশটা আপনার-আমার সকলেরই, এদেশের সামান্য ক্ষতি হলে সেটা আপনার-আমারই ক্ষতি, এই বিশ্বাসটি আজও কারো ভেতরে সমানভাবে প্রোথিত করা সম্ভব হয়নি।
সে কারণেই একপক্ষ ক্ষমতায় থাকলে আরেক পক্ষ তাদেরকে নামানোর জন্য যে ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের আশ্রয় নেয়, তাতে দেশের, মানুষের, অর্থনীতির যে ভয়াবহ ক্ষতি হয় তার দায় কেউ বহন করতে চায় না। সুখের কথা এই যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর থেকে হরতাল নামক সিন্দাবাদের ভয়ঙ্কর দৈত্যটি আপাতঃভাবে হলেও নেমেছে বলে বোঝা যায় কিন্তু সেটা যে আবার ফিরে আসবে না তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই।
আমরা জানি যে, বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থা এই কিছুকাল আগেও বেহাল অবস্থায় ছিল। যমুনা সেতু পূর্ববর্তী উত্তর বাংলাকে এখন চেনা না গেলেও যখন আরিচা থেকে নগরবাড়ি কিংবা বাহাদুরাবাদ ঘাট দিয়ে ফেরি পার হয়ে উত্তর বাংলায় পৌঁছুতে দিন পার হয়ে যেতো তখনকার উত্তর বাংলা যে সত্যিকার অর্থেই একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ ছিল সেকথা আজকে আর কেউ না স্বীকার করুক উত্তর বাংলার জনগণ সেটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন।
এখন যদি কেউ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা তথা খুলনা-বরিশাল-ফরিদপুরের জনগণকে প্রশ্ন করেন যে, কেন তারা পদ্মা সেতুর দ্রুত বাস্তবায়ন চান, তাহলে তারা সমস্বরে একথাটিই বলবেন যে, আসলে তারা পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত হতে চান, কারণ এই মুহূর্তে তারা পৃথিবীর থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়েই আছেন। কোনো মানুষের পক্ষে একবার ফেরিতে করে পদ্মা পার হওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের পর দ্বিতীয়বার সেটা করতে নিতান্ত বাধ্য না হলে তিনি সেটা করতে চাইবেন না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে বরিশাল ও খুলনা এখন জেগে উঠতে শুরু করেছে তাতে পদ্মা সেতু না হলে বাংলাদেশ অচিরেই এক ভয়ঙ্কর দুর্দশায় পতিত হবে, অর্থনৈতিক ভাবে সে দৈন্য কাটিয়ে ওঠা সহজতর হবে না। কিন্তু কী হলো? শুরু থেকেই সেই পদ্মা সেতুকে ঘিরে একের পর এক ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পেলাম। কখনও দেশের ভেতর কখনও বিদেশে পদ্মা সেতু যাতে নির্মাণ সম্ভবপর না হয় সেই তৎপরতা চলতে লাগলো দেশের স্বনামখ্যাত ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত দিয়ে।
এখন নতুন এ বিপদ নিয়ে উপস্থিত এই পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া। গুজব রটিয়ে দেওয়া হলো যে, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য মানুষের বিশেষ করে শিশুর মাথা প্রয়োজন। দেশের ভেতর এই ‘কাটা মাথা’র গুজব এমনভাবে ছড়িয়ে পড়লো যে, সাধারণ মানুষ তাতে উত্তেজিত হয়ে সর্বত্র এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো। গত সাত দিনে অসমর্থিত সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যম প্রায় ১৫টি হত্যাকাণ্ডের খবর দিয়েছে, যেগুলোর সবগুলোই হয়েছে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির মতো বীভৎস কাণ্ডে।
আমাদের বিজ্ঞজনেরা এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে, রাষ্ট্র যেহেতু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেহেতু জনগণও নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। যারা এমন কথা বলছেন তারা প্রথমেই একথা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, যাদেরকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটিয়ে মারা হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই সত্যিকার অর্থেই ‘ছেলেধরা’। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এমন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। নেত্রকোণার ঘটনায় যেখানে একটি শিশুর কাটা মাথা পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে সে সম্পর্কে এলাকাবাসীই বলছেন যে, যাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে ইয়াবা সেবনকারী। তার হাতে থাকা ব্যাগের মধ্যে কোনো শিশুর মাথা পাওয়া যাওয়ার কথা কেউ স্বীকার করেছেন, কেউ করেননি।
অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু শিশুটির মাথার ছবিই নয়, তার বিচ্ছিন্ন শরীরের ছবিও প্রদর্শিত হচ্ছে। বীভৎস এই বর্ণনা আর না দিয়ে একথাটি এখানে বলা জরুরি যে, যা গুজব ও মিথ্যা, যা রটিয়ে দেশের সাধারণ জনগণকে মানুষ হত্যায় উস্কে দেওয়া হচ্ছে তার সঙ্গে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাকে মিলিয়ে ফেলছি কেন আমরা? এমন যদি হতো যে, সত্যি সত্যিই কোনো কারণে ছেলেধরার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে কাউকে মেরে ফেলা হয়েছে তাহলে না হয় বোঝা যেতো যে আইনের ওপর আস্থা না থাকায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে কিন্তু বিষয়টাতো সেটা নয়, একটি পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে জায়গায় জায়গায় নোংরা অপতৎপরতা চালিয়ে সংঘবদ্ধভাবে আরেকজন মানুষকে মেরে ফেলার পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এটা ফৌজদারি অপরাধতো বটেই তার চেয়েও বড় কথা হলো, এটা রাষ্ট্রবিরোধী ভয়ঙ্কর তৎপরতা। এভাবেই হয়তো তারা দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে কেউ বা কোনো পক্ষ।
আমরা স্মরণ করতে চাই ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের কথা। যখন গোটা বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরীতে। চারদিকে রাষ্ট্রবিরোধীরা, রাজনৈতিক ক্ষমতালোভীরা মানুষ হত্যা করে, পরিকল্পিতভাবে দেশের সম্পদ বিনষ্ট করে এবং সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে সরকার পরিবর্তন ঘটানোর হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বলাই বাহুল্য তারা সেটিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থতা থেকে তারা শিক্ষা নেয়নি, বরং তারা নতুন নতুন চক্রান্তে বাংলাদেশ নামক এই উঠ্তি অর্থনীতির দেশটাকে এখন আবারও আক্রমণ করেছে।
নিঃসন্দেহে একথাও অনেক পণ্ডিত এখন বলবেন যে, বাংলাদেশের ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার’ দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ উন্মুক্ত রাখেনি বলেই মানুষ এরকম ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের যুক্তি মেনে নিয়েও একথা বলা যায় যে, যখন দেশে তাদের কথিত ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার’ ছিল না তখনও কেন এদেশে ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রবিরোধী, রাজনীতি-বিরোধী তৎপরতা চলেছিল? কেন এদেশে পঁচাত্তর হয়েছিল? কেন এদেশে একুশে আগস্ট হয়েছিল? কেন সারা দেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছিল? কেন হোলি আর্টিজানে হামলা হয়েছিল? এরকম হাজারো প্রশ্ন দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় কোনো কারণ প্রয়োজন পড়ে না, ক্ষমতায় না থাকলেই তারা ক্ষমতালাভের জন্য এই রাষ্ট্রটিকে যেভাবে যতোভাবে সম্ভব আক্রান্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না।
আজকে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা, বিদেশের পত্রিকায় স্বনামে কলাম লিখে বাংলাদেশকে বাণিজ্যসুবিধা না দেওয়ার আহ্বান, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ না করার জন্য অনুরোধ কিংবা দেশের ভেতর পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের রক্ত দরকার ধরনের গুজব ছড়িয়ে দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করা সবকিছুই আসলে এই রাষ্ট্রবিরোধী-রোগ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
এটা যে কোনো স্বাভাবিক রোগ নয়, এটা যে অতি ভয়ঙ্কর ও নিরাময়-অযোগ্য একটি ব্যাধি-ভাইরাস, যার বাড়বাড়ন্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে আজ হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে, তা বোঝার জন্য আসলে রাজনৈতিক পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই, দেশের জন্য সামান্য ভালোবাসা থাকলেই সেটা বোঝা যায়। দুঃখজনক সত্য হলো, সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে এই রোগাক্রান্ত করা হচ্ছে, অতি দ্রুত এর সুরাহা না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে সত্যিই দুঃশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমকেএইচ