ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হংকং বিক্ষোভ: চীনের প্রতি আস্থার সংকট

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০১:০৬ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৯

৪২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট দক্ষিণ চীন সাগরের ছোট্ট একটা দ্বীপ হংকং। লোক সংখ্যা ২০১৭ সালের গণনা অনুসারে ৭০ লাখের কিছু বেশি। এরা বেশিরভাগ চায়না বংশোদ্ভূত। কিছু ব্রিটিশও আছে। অবশ্য চায়নার অরিজিন হলেও হংকংবাসীরা নিজেদেরকে চাইনিজ পরিচয় দিতে অনাগ্রহী।

প্রায় ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এটি ছিল ব্রিটিশ কলোনি। ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ চীন থেকে ৯৯ বছরের জন্য এটি লিজ নিয়েছিলো। তখন চীনে ছিল রাজবংশের শাসন। ১৯৯৭ সালে লিজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ব্রিটিশ সরকার হংকংকে চীনের হাতে প্রত্যার্পণ করে। চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ কিন্তু তার মূল ভূখণ্ডের শাসন ব্যবস্থা হংকংয়ে প্রয়োগ না করে ব্রিটিশের সময়ের সবকিছু অব্যাহত রাখার কথা স্বীকার করে হংকংকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিল। একজন চিফ এক্সিকিউটিভ নিয়োগ করে চীন।

১৮৯৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২২ বছর হয়ে গেল। দুর্ভাগ্য যে চীন সরকার আর হংকংয়ের মানুষের মাঝে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক এতোদিনেও গড়ে ওঠেনি। চীন সরকার মনে করে হংকংকে পশ্চিমা বিশ্ব যে কোনও সময় চীনের বিরুদ্ধে লীলাভূমি বানাতে পারে। আর হংকংয়ের মানুষ মনে করে চীন সরকার যে কোনও সময় তাদের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে একনায়কতন্ত্রিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

সর্বশেষ ১ জুলাই বিক্ষোভকারীদের কয়েকশ' তরুণের একটি দল আইনসভা ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। বিক্ষোভকারীরা আইনসভা ভবনটির কাচ ভেঙে অধিবেশন কক্ষে ঢুকে এবং স্প্রে-পেইন্ট দিয়ে কক্ষের দেয়ালে নানা রকম বার্তা লিখে দেয়। কেন্দ্রীয় অধিবেশন কক্ষের ভেতরের দেয়ালে হংকং-এর প্রতীকের ওপর একজন বিক্ষোভকারী কালো রং ছিটিয়ে দেয়। আরেকজন পুরোনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের ইউনিয়ন জ্যাক-আঁকা পতাকা তুলে ধরে। পুলিশ বলেছে, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় 'যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে’। এরপর আইনসভা ভবন ঘিরে থাকা বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেছে।

হংকংবাসীর প্রতিবাদের মাত্রা এত তীব্র যে ‘প্রত্যর্পণ বিল’ মানুষের দাবি অনুযায়ী আপাতত কার্যকরী না করে স্থগিত করে দিয়েছে চীন। চীনা নিযুক্ত এক্সিকিউটিভ বিক্ষোভকারীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। হংকংয়ের গত ২২ বছরের ইতিহাসে হংকংয়ে এত বিক্ষোভ আর কখনো হয়নি। প্রতিদিন হংকংয়ের লক্ষ লক্ষ লোক চিনে আরোপিত সব বাধাকে উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করেছে।

কীসের এই ‘প্রত্যর্পণ বিল’? আমি পূর্বেই বলেছি চীন সরকার এবং হংকংয়ের জনগণের মধ্যে আস্থার জায়গাটা দুর্বল। এবারের গণআন্দোলনটি হলো আস্থার অভাবে। তাইওয়ান থেকে এক কুখ্যাত ব্যক্তি পালিয়ে হংকং এসেছিল। তাইওয়ান সরকার হংকংয়ের কাছে ওই কুখ্যাত ব্যক্তিকে ফেরত চেয়েছিল কিন্তু দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ আইন না থাকায় ওই লোকটাকে তাইওয়ানকে ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন হংকং এর চীফ এক্সিকিউটিভের অনুরোধে চীন সরকার একটি প্রত্যর্পণ আইন করে হংকংয়ে পাঠায়।

আইনটির বয়ানের মধ্যে কিছু অস্পষ্টতা ছিল তাতে হংকংয়ের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেছেন যে এই আইনটি তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হবে। তারা দাবি করে যে এই আইনটির অপপ্রয়োগ করে হংকং কর্তৃপক্ষ হংকংয়ের ছোটখাটো অপরাধীকে মূল ভূখণ্ডে পাঠাতে পারবে। নির্যাতনের মাধ্যমে ওইসব অপরাধীকে চীন হত্যা করবে। এই কারণে হংকংয়ের মানুষ প্রত্যর্পণ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে যা তীব্র আকার ধারণ করে।

অবশেষে চিফ এক্সিকিউটিভ আইনটি স্থগিত করে দেয় কিন্তু হংকং এর সাধারণ মানুষের দাবি হচ্ছে আইনটি প্রত্যাহার করতে হবে এবং চীফ এক্সিকিউটিভকে পদত্যাগ করতে হবে। ১৫ জুন আদেশ স্থগিতের পর ১৬ জুন হংকংয়ে এযাবৎকালের বৃহত্তম বিক্ষোভ হয়েছে, যাতে ২০ লক্ষ লোক সমবেত হয়েছিল। আন্দোলনের এক মুখপাত্র বলেছেন দাবি না মানা পর্যন্ত তারা আন্দোলন থেকে বিরত হবেন না। বিক্ষোভ প্রতিদিন অব্যাহত আছে। ১৭ জুলাই প্রায় ২ হাজার সিনিয়র সিটিজেন মিছিল করে একাত্মতা প্রকাশ করে তরুণদের এই আন্দোলনে।

হংকং নিয়ে চীনারা গর্ববোধ করে। কারণ হংকং হচ্ছে সারা বিশ্বের একটি খ্যাতিমান শহর। এর একটি নৌবন্দর এবং একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। সারা বিশ্বের লোকজন এ শহরে আনাগোনা করে। একটি সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী কেন্দ্র হংকং ছোট্ট একটা দ্বীপ হলেও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে এই দ্বীপটির। হংকংয়ের মানুষরা উদার গণতান্ত্রিক চর্চা করছে দীর্ঘ ১০০ বছর ধরে। এখনো তারা উদারভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে। তবে চীনের অধিকারে যাওয়ার পর চীনের একনায়তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চেপে বসে কিনা সে ভয়ে ভীত থাকে।

হংকংয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চর্চা হয়ে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। তারা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি পছন্দ করে না। অবশ্য চীনের হাতে হংকংয়ের অবাধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। চীনারা পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছে হংকংকে। দীর্ঘদিন উদার গণতন্ত্র ও উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত বলে কমিউনিজমের বিরোধী। এখন চীন নিজেই বাজার অর্থনীতি চালু করায় অর্থনীতির ব্যাপারে হংকংবাসী শঙ্কামুক্ত হলেও যেহেতু উদার গণতান্ত্রিক চর্চার ছিটেফোঁটাও চীনে নেই, সে কারণে হংকংয়ের মানুষ মনে করে যে চীনের হাতে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি যে কোনো সময় বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে।

চীনে স্বাধীন সংবাদপত্রের যদিও কোনও ব্যবস্থা নেই কিন্তু হংকংয়ের ‘সাউথ চায়না মনিটরিং পোস্ট’ আর ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ পত্রিকা প্রকাশে চীন কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক গণ আন্দোলনের সময় চীন হংকংয়ের মানুষের উপর নিপীড়ন চালিয়েছে বলে যে অভিযোগ এই নিপীড়নের কারণে মানুষ ভীত হয়েছে। তারা মনে করেছে যে চীন হয়তোবা স্বরুপে আত্মপ্রকাশ করছে। এজন্যই তারা আন্দোলনের মাত্রাও বাড়িয়েছে। অথচ চীন এখন পর্যন্ত হংকংয়ে এমন কিছু করেনি যে এই আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। ফলে হংকং বিক্ষোভকে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট হিসেবে দেখা যেতে পারে।

এর আগে ২০০৩ সালে একটি বিতর্কিত নিরাপত্তা বিলের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ হংকংবাসী রাস্তায় নেমেছিল। সংসদে এই বিল পাসের সম্ভাবনা না থাকায় পরে তা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এবার হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী মিজ লাম-এর অপরাধী প্রত্যর্পণ বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঢেউ ২০১৪ সালের আন্দোলনকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০১৪ সালের গণতন্ত্র-পন্থী আন্দোলনে, যা আমব্রেলা মুভমেন্ট হিসেবে পরিচিত হয়, ৭৯ দিন ধরে হাজার হাজার মানুষ হংকং এর কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক সড়কে ক্যাম্প গেড়ে বসেছিল এবং শহরটি স্থবির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছই হয়নি। এবারের আন্দোলন কত দিনে থামে এখনও দেখার আছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন