ক্রসফায়ারে জনসমর্থন বাড়ছে কেন?
পুরান ঢাকার ওয়ারিতে ছয় বছরের শিশু সায়মাকে ধর্ষণের পর হত্যার মূল অভিযুক্ত হারুনকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করার সংবাদটি শোনার পরে নিউজরুমে আমাদের একজন সহকর্মীর প্রতিক্রিয়া- ‘ওরে মাইরা ফেললো না ক্যান?’
সাধারণ মানুষ তো বটেই, সমাজের শিক্ষিত-সচেতন অংশের মধ্যেও এখন এ জাতীয় অপরাধীকে বিনা বিচারে মেরে ফেলার প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে যার বড় উদাহরণ বরগুনায় স্ত্রীর সামনে রিফাত নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর এলাকায় মিষ্টি বিতরণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই নয়নের নিহত হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
বস্তুত বাংলাদেশের মানুষ যেসব বিষয়ে স্ববিরোধী, তার মধ্যে একটি ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধ। একদিকে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নাগরিকদের যেমন প্রত্যাশা আছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে কোনো শীর্ষ বা চিহ্নিত অপরাধী নিহত হলে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ তারও সমর্থন করে। অথচ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইনের শাসনের পরিপন্থি। একদিকে আইনের শাসনের প্রত্যাশা অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যায় সমর্থনে বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা পরিস্কার; যা রাষ্ট্রের সামগ্রিক চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক।
প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন এ জাতীয় বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে কথা বলে বা নয়ন বন্ডদের মতো অপরাধীরা বিনা বিচারে নিহত হলে আনন্দ প্রকাশ করে? এর প্রধান কারণ, সাধারণ মানুষ মনে করে, যেহেতু প্রচলিত আইনি কাঠামোয় এ জাতীয় অপরাধীর বিচার হয় না বা প্রচলিত বিচারে দীর্ঘসূত্রতা আছে; যেহেতু রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার জোরে অনেক সময়ই অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে যায় এবং পুনরায় একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে; যেহেতু বছরের পর বছর ধরে তাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ থাকে; যেহেতু তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও কেউ কিছু বলার সাহস পায় না; যেহেতু তারা নারীদের ওপর নির্যাতন করে; যেহেতু তারা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে, সুতরাং তাদের এভাবে কথিত ক্রসফায়ারে মেরে ফেলাই ভালো। তার মানে এখানে ক্রসফায়ারের পক্ষে যতটা না সমর্থন, তার চেয়ে বেশি প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা। ফলে সাধারণ মানুষ মনে করে, এ জাতীয় অপরাধীর কোনো মানবাধিকার থাকতে পারে না এবং তারা বিনা বিচারে খুন হলে মিষ্টি বিতরণ করে।
২.
বস্তুত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার জন্যই কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে যেসব দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না। আবার যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করাও কঠিন। যাকে নিয়ে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আতঙ্কে থাকে বা সে যেকোনো সময় বড় ধরনের নাশকতা করতে পারে, এমন আশঙ্কা থাকে- মূলত সেসব অপরাধীকেই বিনা বিচারে হত্যা করে একধরনের বিচার সম্পন্ন করা হয়। আর এটি যাতে আইনিভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে, সেজন্য গল্পটা সাজানো হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, র্যাব বা পুলিশ সব সময় একই গল্প বলে। ফলে এটি এখন আর মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। সত্যিই কোথাও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটলেও মানুষ মনে করে এটা সাজানো। এতে করে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তির।
১৯৭৩ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত এই কৌশলটি প্রয়োগ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এর নাম দিয়েছিল ‘পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু’। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে নিহত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি তাঁকে আটক অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় এবং মরদেহ সাভারের তালবাগ এলাকায় ফেলে রাখা হয়। ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে এই পদ্ধতির পুনঃপ্রয়োগ শুরু হয়। ওই সময় সন্ত্রাস দমনের জন্য স্বল্পমেয়াদী অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে অর্ধ শতাধিক মানুষ নিহত হয়। মূলত ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পরে জঙ্গি ও শীর্ষ অপরাধীদের দমনে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ অনেক বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে।
কিন্তু যে প্রশ্নটি বারবার সামনে এসেছে তা হলো, এভাবে বিনা বিচারে অপরাধীদের মেরেও কি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধ দূর করা গেছে? সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ক্রসফায়ার সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি। উপরন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অনেক সময়ই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে নিরপরাধ লোককে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার অনেক উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনেও যখন ক্রসফায়ার ব্যবহৃত হতে থাকে।কিন্তু সাধারণ মানুষের যে অংশ একজন শীর্ষ অপরাধীকে বিনা বিচারে মেরে ফেলায় আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে, তাদের পক্ষে একজন নিরপরাধ লোক ক্রসফায়ারে নিহত হলে তার প্রতিবাদ করার নৈতিক অবস্থান থাকে না।
ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধে অপরাধী নির্মূলকে অনেক সময় প্যারাসিটামলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ জ্বর হলে মানুষ যেমন তাৎক্ষণিকভাবে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেয়ে তাৎক্ষণিক উপশম পায়, ক্রসফায়ারও আপাতদৃষ্টিতে একজন অপরাধীকে দুনিয়া থেকে বিদায় করলেও সে যেসব কারণে অপরাধী হয়ে উঠলো, যারা তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলো, যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সে অপরাধী হয়ে উঠতে পারলো, সেই বিষয়গুলো আড়ালে থেকে যায়।
অনেক সময় একজন অপরাধীকে ক্রসফায়ারে খুনের মধ্য দিয়ে তাকে লালন-পালনকারী শীর্ষ অপরাধীরা বেঁচে যায়। কারণ তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো সাক্ষী থাকে না। বরগুনায় নয়ন বন্ডের নিহত হওয়ার পরও এই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে যে, শুধু একজন নয়নকে মেরে ফেললেই সমস্যার সমাধান হবে কি না? বরং যারা তাকে এতদিন প্রশ্রয় দিয়েছে, যারা একজন সাধারণ নয়নকে নয়ন বন্ডে পরিণত করলো, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের বিচার হবে কি না? যদি না হয়, তাহলে আজ একজন দুজন দশজন নয়নের নিহত হওয়ার পর মানুষ মিষ্টি বিতরণ করবে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আরও অনেক নয়ন তৈরি হতে থাকবে।
এরকম বাস্তবতায় বরগুনায় নয়ন বন্ডের নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিনা বিচারে হত্যার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতিরা বলেছেন,তারা বিনাবিচারে হত্যা পছন্দ করেন না। একই কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। আওয়ামী লীগও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না বলে তিনি জানান।
বাস্তবতা হলো দেশে আইনের শাসন থাকলে ক্রসফায়ার লাগে না। অর্থাৎ বিচারে যদি দীর্ঘসূত্রতা দূর হয়; যদি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হয় এবং আইনশৃঙ্খা বাহিনী পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সঠিক রিপোর্ট দেয়; যদি বিচারসংশ্লিষ্টরা সৎ ও আন্তরিক হয়; যদি বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে; যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকে; যদি পয়সার কাছে তারা বিকিয়ে না যায়, তাহলে বিনা বিচারে কাউকে খুন করার প্রয়োজন হয় না। বরং যত বড় অপরাধীই হোক, প্রচলিত আইনেই তার সর্বোচ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থাবান হলে বন্দুকযুদ্ধ লাগে না। কারণ, যে সমাজে আইনের শাসন আছে, সেই সমাজে ক্রসফায়ার থাকে না।
সুতরাং যতদিন না দেশে সত্যিকারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিচারসংশ্লিষ্টরা নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে, ততদিন পর্যন্ত হয়তো বিনাবিচারে নয়ন বন্ডদের নিহত হওয়ার পর মানুষের মিষ্টি বিতরণ অব্যাহত থাকবে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়ন্টিফোর।
এইচআর/এমকেএইচ