ধর্ষক শিক্ষক : বিশ্বাসের মূলে আঘাত
নারায়ণগঞ্জে এক স্কুল শিক্ষক ও মাদ্রাসা শিক্ষককে গ্রেপ্তারের পর তাদের সম্পর্কে ভয়ংকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। উভয়ই ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেল করে ধর্ষণের অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। অনেকদিন ধরেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষকদের সম্পর্কে এমনসব খবর আসছে আর চারদিকে গেল গেল রব উঠছে।
শিশুর শিক্ষা প্রথমে শুরু হয় পরিবারে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পিতামাতার থেকে চলে আসে শিক্ষকের উপর। শিক্ষক সারাজীবনের অর্জিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান শিক্ষার্থীকে দান করেন। এমন করেই জ্ঞানের আলোয় বিকশিত হয় শিক্ষার্থীর মন। সভ্যতার বিকাশ এভাবেই গড়ে উঠেছে। এই শিক্ষাদান এবং গ্রহণের মধ্যে দিয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে শ্রদ্ধা-ভালবাসার অটুট বন্ধন।
কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের চিরকালীন মাধুর্য আর থাকছে না এদেশে। যে বিশ্বাস নিয়ে একজন অভিভাবক সন্তানকে শিক্ষকের কাছে পাঠান, নারায়ণগঞ্জের ঘটনা, ফেনীর নুসরাত হত্যার পর, ধারণা হচ্ছে সেই বিশ্বাসই ধর্ষিত হয়ে গেছে। মাদ্রাসা শিক্ষক ১২ জনকে, আর স্কুল শিক্ষক ২০ জনকে ধর্ষণ করেছেন। কিন্তু ধর্ষণতো কেবল সংখ্যাতত্ত্ব নয়– ধর্ষণ মানে অমানবিক নির্যাতন, জঘন্য অপরাধ, ভয়াবহ হিংসার প্রকাশ। প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনাই এমন অসংখ্য অপরাধ।
এসব ঘটনার অনেক তাৎপর্য আছে। মানুষ আগে যে দৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখতেন, এখন আর সে ভাবে দেখেন না। আগে কোনও অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠিত হলে এলাকাবাসী দলমতনির্বিশেষে তাকে কেন্দ্র করে এলাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে চাইতেন। এক একটি প্রতিষ্ঠান একেকটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠত।
এখন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা দখলের কেন্দ্র। রাজনৈতিক দল আর তাদের নেতারা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে দখল করে পাড়ার মাস্তান চক্রের স্বর্গ বানিয়েছে। একজন দু’জন নুসরাত প্রতিবাদ করে মরে গিয়ে জানান দেয়, বাকি সব নিরবে সয়ে যায়। যে সমাজ শিক্ষাক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ফুর্তির প্রাঙ্গণ হিসেবে দেখে, সেই সমাজের অবক্ষয় সম্বন্ধে আর কোনও সংশয় থাকে না।
বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে যে পিছিয়ে যাচ্ছে এগুলো তার প্রমাণ। বৃহত্তর সমাজকেও একটা বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা শাস্তি চাই অপরাধীর। কিন্তু শাস্তি দিয়ে অপরাধের পথে একটা বাধা তৈরি করা যায় নিশ্চয়ই, কিন্তু সামাজিক সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কাজটাও তার চেয়ে কম জরুরি নয়।
যে শিক্ষক এমন অনৈতিক কাজ করছেন তারা পুরুষ। তারাও পরিবার থেকেই আসে। কিন্তু সেই পরিবার থেকে এদের সংবেদনশীলতা শেখানো হয়নি। অংসখ্য ধর্ষকের মত এই ধর্ষক শিক্ষকরাও শিখে আসেনি যে, মেয়েরাও তাদের সমান। মেয়েরা শুধু ছেলেদের কাছে ভোগের বস্তু নয়।
সংবেদনশীলতার এই চর্চা ছড়িয়ে পড়া দরকার পরিবহনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিসে আদালতে। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাসে, ট্রেনে নারীদের প্রতি দিনের উপস্থিতি যেন নিরাপদ হয়। একটা ঘটনা প্রকাশিত হলে, জানা গেলে সবাই কিছুদিন কথা বলি। তারপর আবার ভুলে যাই। আমাদের নারীরা বিপন্ন হতে থাকবে, আর আমাদের সমাজ, আমাদের সরকার নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকে যতক্ষণ না আরেকটি ঘটনা ঘটছে।
একজন শিক্ষকের কাছে থেকে শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা হল তাকে জীবনে বড় হওয়ার পথ দেখাবেন তিনি, যেন সে নিজের জীবনকে নিজের মতো তৈরি করতে পারে। বহুদিন ধরে দেখছি, শিক্ষকরা সেই জায়গাটিতে নেই। প্রায় এক দশক ধরে এ ধরনের খবর বেশি বেশি আসছে। কুষ্টিয়ার এক শিক্ষকের কথা বিশ্বময় ছড়িয়ে গিয়েছিল– তিনি কিভাবে ছাত্রীদের ফুসলিয়ে ধর্ষণ করতেন সেই গল্প নাকি সচিত্র পাওয়া যায় পর্ণ সাইটে। খোদ রাজধানীর ভিকারুন্নিসা স্কুলের শিক্ষক পরিমলের কথাও আমরা জানি।
একটা সময় শিক্ষকদের অনৈতিকতা বলতে ধারণা ছিল, ক্লাশে পড়ানোর চেয়ে অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়ানোয় কিছু শিক্ষকের অতি আগ্রহ। এখন সেটি ছাড়িয়ে এরকম বাধহীন যৌন লালসায় নিজেদের নিবেদিত করেছেন এমন অসংখ্য শিক্ষক।
সুবিধা হল, এ ধরনের কাজ করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্ত শিক্ষকরা। ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাও প্রায় পার পেয়ে গেছিলেন। আমরা দেখেছি তার পক্ষে পুলিশ ছিল, প্রশাসন ছিল এবং ছিল স্থানীয় রাজনীতি। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নানা সমীকরণে বহু অভিযুক্ত শিক্ষক পার পেয়ে যান। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কলরব উঠায়, প্রধানমন্ত্রী নিজে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা ঘটনা নজরদারীতে রাখায় এ যাত্রায় সিরাজউদ্দৌলা ও তার সহযোগীরা বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।
নারী ও শিশু ধর্ষণের বহু ঘটনা ঘটছে কিন্তু তার বিচার এবং শাস্তি হচ্ছে খুবই কম। ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। এছাড়া ধর্ষণের বিচার পেতেও নারীকে পদে পদে হয়রানি আর অবমাননার শিকার হতে হয়। এটি হল একটি দিক। আরেকটি ভয়াবহ দিক সমাজের নজরেই আসছে না। মাদ্রাসাগুলোয় ছেলেরা নিয়মিত বলাৎকারের শিকার হয়, কিছু কিছু সাম্প্রতিককালে প্রকাশিতও হচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এটি কোন আলোচনায় নেই। এটিকে খুব স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে।
ধর্ষণ মামলায় মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশের শেষ পর্যন্ত সাজা হয়। তাই ধর্ষণ কমানোর জন্য কি করণীয় তা নিয়ে বড় ভাবনা প্রয়োজন। কিস্তু শিক্ষাঙ্গনে যা ঘটছে তার সমাধান কী? আইনী প্রতিকারের বাইরে স্থানীয় মানুষদের শিক্ষা-সংস্কৃতির মানোন্নয়নে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এত নিচে নেমে গেছে যে, এদের কাছে আর কিছু আশা করে লাভ নেই। মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা যারা থাকেন তাদের উদ্যমী হতে হবে। নানা এলাকায় এখনও সচেতন মানুষ একেবারে হারিয়ে যাননি। তাদের সাথে নিয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির সুস্থতার প্রচেষ্টাটা আবার শুরু করা যেতেই পারে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জেআইএম