কু ঝিক ঝিক ঝিক রেল লাইন হোক ঠিক
রেলপথে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা মাত্রই জানেন, ট্রেন গন্তব্যে থামার পর একটি ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, ‘আশা করবো নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও নির্ভরশীল ভ্রমণের জন্য পরবর্তীতেও আপনি রেলপথকেই বেছে নেবেন।’ হুবহু একইরকম এবং বহুবার শোনা হলেও ট্রেন থেকে নামার সময় এই ঘোষণাটি আনন্দ দেয় এই কারণে, এখনো মানুষ মনে করে ট্রেনে ভ্রমণ নিরাপদ ও আনন্দদায়ক। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে?
সেই যে, বাবা-ঠাকুরদাদারা বলে গেছেন, এই রেলপথ ব্রিটিশ আমলের বলেই এতোদিন টিকে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় সেটাই যেন সত্যি। এর মধ্যে হয়তো অনেক জায়গায় নতুন লাইন বসেছে, নতুন পথ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু রেলকে যতোটুকু অগ্রগতি বা সেবা পরিষেবার দিক দিয়ে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। পাশের দেশ ভারত বা এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর কথা বলতে গেলেও আমরা অনেক পিছিয়ে। এবং এই পিছিয়ে থাকার একমাত্র কারণ বলা যায় কর্তা ব্যক্তিদের আগ্রহের অভাব, অসহযোগিতা বা অমনোযোগিতা।
জনবলের অভাব রয়েছে এটা যেমন সত্যি কিন্তু অতিমাত্রায় অবহেলা রয়েছে সেটাও সত্যি। ২৩ জুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকার কাছেই সেতু ভেঙে আন্তঃনগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে চার জনের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় প্রায় একশো জন। এই ঘটনায় প্রাণহানি আরো বেশি হতে পারতো কিন্তু ছোট খাল এবং পানি কম থাকায় অনেকে রক্ষা পেয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশে যেসব ট্রেন যাতায়াত করে সেগুলোর সর্বোচ্চ গতি ৫০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার। গতি কম থাকায়ও রক্ষা পেয়েছেন অনেকে। সেদিন রাতে ঘটনাস্থলে এবং পরদিন ভোরে যে সাতটি বগিতে করে যাত্রীরা ঢাকায় ফিরেছেন তাদের মধ্যে ছিল ভয়াবহ আতঙ্ক, একই সঙ্গে অনেকে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, তারা যে বেঁচে ফিরবেন সেটাই ভাবতে পারেননি। ধারণা করা যায়, যতোই নিরাপদ বলে ঘোষণা দেয়া হোক না কেনো এসব যাত্রীরা অনেকদিন ট্রেনে চড়তে ভয় পাবেন।
এমন ট্রেন দুর্ঘটনা কিন্তু হরহামেশাই দেশে ঘটে থাকে। তাতে হয়তো প্রাণহানি কম হয় বলে ততোটা আলোচিত হয় না। অবশ্য আমাদের রেলমন্ত্রী সংসদে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, সেতু ভেঙে নয়, লাইন পরিবর্তন করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার এই ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষ কতোটা গ্রহণ করেছেন সেটা বলা মুশকিল। রেলওয়ের তথ্য মতে, সারাদেশে মোট যে চার হাজার চারশ তেতাল্লিশ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে, তার মধ্যে সেতুর সংখ্যা ৩ হাজার ছয়শ বায়ান্নটি। ৩৪৭টি ট্রেনে যাত্রী চলাচল করে বছরে প্রায় ৫০ লাখ।
এই বিপুল সংখ্যক যাত্রীর নিরাপত্তায় কতেটা কাজ করে রেলওয়ে। অধিকাংশ রেলপথই অরক্ষিত। পাথর নেই বিভিন্নস্থানে, এমনকি শক্ত মাটিও নেই। ফলে ট্রেন যাওয়ার সময় লাইন ডেবে যায়। কোথাও কোথাও স্লিপারের সাথে বাঁশ দেয়ার তথ্যও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। আর সেতুর অবস্থাও তথৈবচ। সেই কবে বানানো হয়েছিল। অনেকের ভাষায় ‘ব্রিটিশ আমলে’! এই যে কুলাউড়ায় দুর্ঘটনা সেখানের আশেপাশেও কিন্তু সংবাদকর্মীরা রেলপথে পাথর দেখেননি। নাট-বল্টু অনেক জায়গায় খোলা। সমস্যা হচ্ছে, আমরা বানাই, ভুলে যাই, আবার বানাই। সেটিকে যে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় সেটিই ভুলে যায়। টেকসই ও নিরাপদ রাখার সংস্কৃতিটাই গড়ে উঠেনি। তার মানে রেলওয়ের কি উন্নতি হয়নি?
হ্যাঁ, তা হয়েছে। একের পর এক বড় বড় প্রকল্প আসছে। তা নিয়ে ডুবে থাকার কারণে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি ভুলেই গেছেন কর্তাব্যক্তিরা। তাই দেখভালের বিষয়টিতে আরো কঠোর মনযোগী হতে হবে। নিয়মিত অডিট করা দরকার এবং সেটি ফাইল চাপা না রেখে সে অনুযায়ী কাজ করাও দরকার। আশার কথা ২৫জুনের একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে সড়ক ও রেলপথের সব সেতু ও কালভার্টের অবকাঠামো জরিপের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু চিহ্নিত করে বর্ষার আগেই মেরামত করার উদ্যোগ নিতে বলেছেন তিনি।
আমাদের দেশে এই আরেক সমস্যা, সবকাজে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতেই হয়। এ বিষয়ে সম্প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে একটি মামলার পর্যবেক্ষণ দিতে গিয়ে আদালত প্রশ্ন তোলেন, ‘সব কাজ যদি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয় তবে সচিবরা কেনো আছেন?’ সচিবরা কেনো আছেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। রসিকতা করে বলা যেতে পারে, তারা রয়েছেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরির জন্য।
যাত্রাপথে অবকাঠামোগত কোচ, সিট, ছারপোকার কামড়ের সমস্যা বাদ দিলেও বিপদ আপদের যেন শেষ নেই। চলন্ত ট্রেনে প্রায় পাথর ছোড়া হয়। এতে আহত হন যাত্রীরা। এমনকি জানালা বন্ধ রেখেও রেহাই নেই। পাথরের কারণে জানালার কাচ ফেটে আহত হন যাত্রীরা। গেলো মাসে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী ট্রেনে ভ্রমণের সময়ও পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল। ওই ঘটনায় অবশ্য তিনি নিরাপদে ছিলেন।
পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ যে রেলমন্ত্রী গণমাধ্যমে বিবৃতিও দিয়েছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে ট্রেনে পাথর ছুড়ে দুহাজারের বেশি জানালা ভাঙা হয়েছে। ২০১৩ সালে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া ঢিলে প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নিহত হন। এর মধ্যে আহত হয়েছেন অনেকে। তবে রেলওয়ে আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও কারো শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই।
এছাড়া ছিনতাই করার পর ট্রেন থেকে ফেলে হতাহতের ঘটনা হামেশাই ঘটছে। গেলো ১৩জুন ফেনী এলাকায় চট্টলা এক্সপ্রেসে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে নিরাপদ ভ্রমণের জন্য যে যাত্রীরা ট্রেনকে বেছে নেন তারা যেন আস্থার সংকটে ভুগছেন। কিন্তু উপায়ও নেই। কারণ সড়কপথের দুরবস্থা আবার কিছুটা সহজলভ্যতার কারণে ট্রেনই ভরসা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেখানে রেলপথ যাত্রাকে ধরে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে সেখানে আমরা পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে অনেকে জটিল হিসেবও কষে থাকেন।
যেমন, একটি চক্র যারা সড়কপথে বাস চলাচলের সাথে যুক্ত তারাও চায় না রেলপথ উন্নত হোক। কারণ তাতে যাত্রী হারাতে হবে সড়কপথের। এদের সঙ্গে রেলের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। রয়েছে সিন্ডিকেটও। সে কারণে ট্রেনের কৃত্রিম টিকিট সংকট, ভাড়া বেশি নেয়া, দেরিতে ট্রেন ছাড়া এবং সেবা না দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এসব বিষয়ে জানতে গিয়ে এক টেলিভিশন সংবাদকর্মীকেতো আত্মহত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন রেলসচিব (বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হয়)।
কাজেই রেলকে সঠিক পথে চালাতে গেলে, জনমানুষের কল্যাণের সমান্তরালে চালাতে হলে এসব দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। কারণ রেল পরিষেবা অনেক প্রাচীন। এর মাধ্যমেই অপেক্ষাকৃত সহজে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। অতীতে অনাকাঙ্খিত অনেক ঘটনা থেকে বোঝা যায়, রেলের সিন্ডিকেট কতোটা শক্তিশালী। অনেক সময় মন্ত্রী,সচিবও সেখানে অসহায় থাকেন বলে জানি। তাই চক্র ভাঙতে হলে প্রশাসনকে সেই শক্তি নিয়েই এগুতে হবে।
যদি সত্যিকারের জনবান্ধব রেলসেবা দেয়া যায় তবেই রেল লাভজনক হয়ে উঠবে। এমনিতে টিকিট পাওয়া দুস্কর অথচ ফি বছর শোনা যায়, রেল লোকসানি খাতে রয়েছে। এসব কিছুর কারণ বের করাও জরুরি। তবেই ছেলেবেলায় ‘কু ঝিক ঝিক’ রেলগাড়ি পড়তে পড়তে যে ট্রেনে চড়ার স্বপ্ন দেখা হয় সেটি হয়ে উঠবে নিরাপদ ও আনন্দময়। নইলে রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে হবে আলুর দম।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, সময় টেলিভিশন ও সাহিত্যিক ।
এইচআর/জেআইএম