প্রশ্নবিদ্ধ আলিম দার এবং আইসিসি
আলিম দার, বাংলাদেশের বিপক্ষে বরাবর এই আম্পায়ারের পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তের কারণে অনেকের আলোচনার কিংবা সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। অনেকের জানারও ইচ্ছা, কেন বাংলাদেশের প্রতি তার এতো রাগ? কোন এক অজানা কারণে বাংলাদেশের প্রতি তার বিদ্বেষের যেন শেষ নেই। কিন্তু আম্পায়ার হিসেবে তাকে থাকতে হবে সকল প্রকার প্রশ্নের উপরে। সেটা আইসিসির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু সেটা তিনি কি আদৌ পারছেন? তিনি কি স্বপ্রণোদিত হয়েই কারো পক্ষে কিংবা কারো বিপক্ষে যাচ্ছেন? নাকি বাংলাদেশের বিপরীতে কোন এজেন্ডা নিয়েই মাঠে নামেন। কারণ তার বিতর্কিত সিদ্ধান্তসমূহ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
আজ বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচ রয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বাঁচা মরার লড়াই। এখানে দুই দলকে সমানভাবে খেলার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে আম্পায়াররা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। ২০১৫ এর কোয়ার্টার ফাইনালের পরে বাংলাদেশ ভারত ম্যাচে আলিম দারকে আম্পায়ার রাখা হবে, এটা কেউই ভাবতে পারেনি। আইসিসির সেটাই করলো।
২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটির কথা ভুলে যাবার নয়। প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলছিল বাংলাদেশ। বিভিন্ন চাপের মধ্যেও দারণ খেলছিল। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচের আম্পায়ার ছিলেন আলিম দার ও ইয়ান গোল্ড। রুবেল হোসেনের একটি ফলটস বল রোহিত শর্মার কোমরের নীচে থাকলেও, লেগ আম্পায়ার আলিম দারের পরামর্শে ‘নো বোল’ ডাকেন ইয়ান গোল্ড। ফিল্ড আম্পায়ার ইয়াল গোল্ডও ঘোষণা করলেন, এটা নো বল, রোহিত আউট হননি! সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে আম্পায়ারের এই অবাক করা কর্মকাণ্ড।
বলটি নো বল হবার মতো উঁচু ছিল না। এমনকি আম্পায়ারকে বিভ্রান্ত করতে পারে এমন উঁচুতেও ছিল না। খোদ ভারতের ক্রিকেটারও এর প্রতিবাদ জানান। ক্রিকেট বিশ্বে বাজে দৃষ্টান্তের সৃষ্টি হয়। এখানেই শেষ হয়নি। সেই কোয়ার্টার ফাইনালেই ভারতের বিপক্ষে ব্যাট করতে নেমে দলীয় ৭৩ রানে মোহাম্মদ শামির করা শর্ট বলে ধাওয়ানের হাতে ক্যাচ দেন মাহমুদুল্লাহ। ধাওয়ান বাউন্ডারি লাইনের একদম কাছে ছিলেন বলে আম্পায়ার থার্ড আম্পায়ারের কাছে যান সিদ্ধান্তের জন্য। যেখানে স্পষ্ট দেখা যায়, ধাওয়ানের পা বাউন্ডারি লাইনের সাথে লেগে থাকা অবস্থায় ক্যাচ ধরেছেন। সকলেই ভেবেছিল টিভি আম্পায়ার স্টিভ ডেভিস বিগ স্ক্রিনে ‘নট আউট’ লোড করবেন, কিন্তু লোড হল ‘আউট’!
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যে আলীম দারের বাজে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অন্তত সেই আলীম দারকে বাংলাদেশের কোন খেলায় সংশ্লিষ্ট করা উচিত ছিল না। আইসিসির এই বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। অথচ চলতে বিশ্বকাপের আফগানিস্তানের সাথে খেলায় তিনি থার্ড আম্পায়ার ছিলেন। তিনিই আবার নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন। বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের মধ্যকার ম্যাচটি বাংলাদেশ দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ সেমিফাইনালের স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে হলে এই ম্যাচে বাংলাদেশকে জিততেই হবে।
বাংলাদেশ তাদের ব্যাটিং ইনিংস শুরুও করেছিল দারণভাবে। তামিম কিছুটা ধীরে শুরু করলেই লিটন দাস বলের সাথে পাল্লা দিয়েই স্কোর শুরু করেছিলেন। ১৭ বলে ১৬ রান। বড় ইনিংসের ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলে লেগ স্পিনার মুজিব-উর-রহমানের বলে ক্যাচ উঠিয়ে দেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ফিল্ডার হাসমতউল্লাহ শহিদি বলটি লুফে নেন। তবে তিনি সঠিকভাবে ক্যাচটি নিতে পেরেছেন কিনা তা নিয়ে মাঠের আম্পায়ার মাইকেল গফ ও রিচার্ড কেটেলবরো নিয়ে দ্বিধায় পড়েন। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।
যে কারণে প্রাথমিকভাবে আউটের সংকেত দিয়েও থার্ড আম্পায়ারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মাঠের আম্পায়ার অপেক্ষা করতে থাকে। এই অপেক্ষা শুধু মাঠের আম্পায়ারদের ছিল না, গ্যালারী ভর্তি দর্শকদের অপেক্ষা ছিল, টিভি স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমী মানুষের অপেক্ষা ছিল। টিভি স্ক্রিনে দেখা যায়, বল ফিল্ডারের তালুবন্দি হওয়ার আগেই মাটি স্পর্শ করেছে বলেই মনে হচ্ছিল। এমনটা সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন ধারাভাষ্যকারও।
যে টিভি রিপ্লে থার্ড আম্পায়ার আলিম দার দেখছিলেন, কোটি কোটি মানুষও সেই স্ক্রিন দেখছিলেন। কিন্তু তারপরেও তিনি লিটন দাসকে আউট ঘোষণা করলেন। যে ক্যাচটি নিয়ে এত সন্দেহ, সেই ক্যাচটির বেনিফিট অব ডাউট তো ব্যাটসম্যানের পাবার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা হলো না। এটা ক্রিকেটের জন্য সুখকর কিছু না। একই ম্যাচে সৌম্য সরকারের আউট নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
মুজিব-উর-রহমানের বত্রিশ ওভারের শেষ বলটি সৌম্য সরকারের প্যাডে লাগে। তাতেই জোর আবেদন জানায় আফগানিস্তান। ফিল্ড আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে দেন। রিভিউ নেন সৌম্য সরকার। রিভিউ দেখলেন থার্ড আম্পায়ার। কিন্তু সেখানে দেখা হলো না আলট্রা এজ! অথচ মনেই হচ্ছে ব্যাট স্পর্শ করে বলটি প্যাডে লেগেছে। আলট্রা এজ দেখার ধারে কাছে গেলেন না থার্ড আম্পায়ার আলিম দার। তিনি দেখলেন বলের লাইন। আর সেটা দেখেই রিভিউতে আফগানিস্তানের পক্ষে রায় দিলেন।
সাধারণত লাইন দেখার পাশাপাশি আলট্রা-এজটাও থার্ড আম্পায়ার দেখেন, যা দর্শকরাও দেখেন। কিন্তু সৌম্য সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায় আলট্রা এজের ধারে-কাছেও গেলেন না থার্ড আম্পায়ার আলীম দার। এত তাড়া কেন ছিল, ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছে সেটাই বড় প্রশ্ন? কোন আম্পায়ার যদি একাধিকবার একটি দলের বিপক্ষে অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়, তাকে ঐ দেশের খেলা থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়। সেটা কেন আইসিসি করছে না, সেটাই এখন কোটি মানুষের প্রশ্ন। আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচের পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও আলিম দারের সমালোচনা করেছেন। আলিম দারের কাছ থেকে তিনি পক্ষপাতমূলক এরকম সিদ্ধান্ত তিনি আশা করেন না। এমনকি সময় পেলে তিনি আলিম দারকে এই বিষয়ে বলবেন বলেও ঘোষণা করেছেন। সবাই বিষয়টা বুঝলেও আইসিসি নিরব কেন?
আইসিসি কোন ধরনের তদন্ত করেছে কিনা? যদি না করে থাকে, তবে সেটা দুঃখজনক। বাংলাদেশের কপাল কিছুটা ভালোও বলা চলে। কারণ বাংলাদেশ বনাব শ্রীলংকার ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়। ঐ ম্যাচেও টিভি আম্পায়ার হিসেবে থাকতেন আলিম দার। যদি ম্যাচটি পরিত্যক্ত না হতো, তাহলেও সেই ম্যাচেও হয়তো আলিম দারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দেখতে হতো।
এবারের বিশ্বকাপে ইতোমধ্যেই কয়েকটি ম্যাচে পাতানো খেলার অভিযোগ উঠেছে। ইচ্ছা করে রান আউট করা হচ্ছে না। কেউ কেউ ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খেলা ছেড়ে দিচ্ছে। সেরা ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে কোন দেশের খেলোয়াড় উইকেট হাতে থাকা সত্ত্বেও মন্থর গতিতে ব্যাটিং করে শেষে লো রান রেটের কারণে হেরে যাচ্ছে। আইসিসির এগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত করা উচিত। যদি পাতানো খেলা হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রত্যেকেই চায় খেলাটা উপভোগ্য হোক। খেলা যেন খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। খেলাটি যেন শুধুমাত্র নিখাদ বিনোদন হয়। এখানে যেন কোন চতুরতা না ঢুকে পড়ে। তবে এটা ঠিক আলিম দার আম্পায়ার থাকার কারণে বাংলাদেশ কিছুটা চাপেও থাকবে। রেফারেল নিতেও হয়তো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। এসব কিছুই ক্রিকেটের উন্নয়নে অশনিসংকেত।
আলিম দারের উচিত নিরপেক্ষভাবে ম্যাচ পরিচালনা করা। আইসিসির উচিত আম্পায়ারদের কঠোর বার্তা প্রেরণ করা। আম্পায়ারকে সবসময় নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়। তার দিকে মাঠের খেলোয়াড়সহ অগণিত দর্শক তাকিয়ে থাকে। তাদের পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্ত ক্রিকেটের ইমেজকে নষ্ট করে দেয়। ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে খ্যাত ক্রিকেটও তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ক্রিকেট সকল বিতর্কের বাইরে থাকুক, এটাই ক্রিকেট প্রেমী সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
এইচআর/এমএস