স্যানিটারি প্যাড, সঞ্চয়পত্র, গ্যাস ও মধ্যবিত্ত
সরকারি চাকরিজীবী ফুপার মৃত্যুর পর সন্তানহীন ফুপুর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পেনশনের টাকায় চালু করা পারিবারিক সঞ্চয়পত্র। বছর সাতেক ধরে এই টাকাই তার প্রধান অবলম্বন। কারণ তার পক্ষে ওই টাকা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করে নির্ভার থাকা কিংবা এই বয়সে এসে চাকরি বা কোনো ব্যবসা করা সম্ভব নয়। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ থেকে মাসে মাসে যা পান, তাই দিয়ে মফস্বল শহরে মোটামুটি খেয়েপরে বেঁচে আছেন। কিন্তু এখন সেই টাকার মুনাফা থেকেও তাকে দ্বিগুণ উৎসে কর দিতে হবে।
পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ানোর যে প্রস্তাব ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে দেয়া হয়েছিল- তার বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ তো বটেই, বাজেট আলোচনায় অধিকাংশ সংসদ সদস্য এবং মতিয়া চৌধুরীর মতো সিনিয়র এমপি ও সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে এই দ্বিগুণ কর বহাল রাখা হয়েছে।
যারা পারিবারিক সঞ্চয়পত্র খুলেছেন, তাদের একটা বড় অংশই অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী এবং এটা তাদের বৈধ টাকা। সুতরাং এখান থেকেও ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা কোনো অর্থেই মানবিক নয়। বাজেট আলোচনায় মতিয়া চৌধুরীও অর্থমন্ত্রীকে এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, যেখানে ব্যবসায়ীদের নানাভাবে সুবিধা দেয়া হচ্ছে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, সেখানে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর দ্বিগুণ করার প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য নয়।
অন্য জায়গায় বিনিয়োগের ঝুঁকি, ব্যক্তি খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে নিয়মিত মুনাফার নিশ্চয়তা না থাকা, যেকোনো ব্যবসা করতে গেলে নানারকম চাঁদা ও হয়রানির শঙ্কাসহ নানা কারণেই অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা নিশ্চিত মুনাফার জন্য প্রথমত এবং প্রধানত নির্ভর করেন এই সঞ্চয়পত্রে। কিন্তু এখানেও উৎসে কর দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়ার পর থেকেই মুনাফা তুলে নিতে ব্যাংক ও পোস্ট অফিসের সামনে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। বিশেষ করে যেসব পরিবার এই সঞ্চয়পত্রের উপরেই নির্ভরশীল, তাদের মধ্যে একধরনের হতাশাও তৈরি হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় উৎসে কর দ্বিগুণ করার পেছনে সরকারের মূল উদ্দেশ্য এই খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করা। কেননা অন্যান্য বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে বেশি মুনাফার কারণে এখানে মানুষের আগ্রহ বেশি যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে মনে করা হয়। ফলে এখানে উৎসে কর বাড়িয়ে মানুষকে হয়তো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার একটা উদ্দেশ্যও সরকারের আছে। কেননা এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, পুঁজিবাজারে সবার আস্থা নেই; এখানে নানারকম কারসাজি চলে। সেই কারসাজিরে চক্করে পড়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী যদি সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেন, রাষ্ট্র কি তার পাশে দাঁড়াবে?
তাছাড়া সবাই এই বাজারটি বোঝে না বা অনেকের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভবও নয়। যেখানে একজন সাবেক অর্থমন্ত্রীই এটাকে ‘ফটকা বাজার’ বলে মন্তব্য করেছেন, সেখানে অতি সাধারণ অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী কিংবা যাদের কোনোভাবেই অন্য কোথাও বিনিয়োগের সুযোগ নেই, তারা সঞ্চয়পত্রকেই ভরসা মানেন। কিন্তু ভরসার জায়গাটিও আর নিরঙ্কুশ থাকলো না।
২.
সংসদে যেদিন (৩০ জুন) ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হলো, সেদিন বিকেলেই গ্যাসের দাম বাড়ানোরও ঘোষণা দেয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নামে ‘কমিশন’ হলেও এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে অনেক সময়ই এটা মনে হয় যে, তারা জনগণের স্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর স্বার্থ বেশি দেখতেই পছন্দ করে। নামে রেগুলেটরি বা নিয়ন্ত্রণ কমিশন হলেও আদতে তাদের ‘মূল্য সমন্বয় কমিটি’ বলাই ভালো।
এ দফায় গড়ে ৩২.৮ শতাংশ বেড়েছে গ্যাসের দাম যা কার্যকর হয়েছে জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকেই। এখন থেকে এক চুলা ৯২৫ টাকা ও দুই চুলায় ৯৭৫ টাকা মাসিক বিল দিতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে বিইআরসিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ফলে এ প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত যে, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো কোন সাহসে গ্যাসের দাম শত ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে? তাদের কাজ শুধু মুনাফা করা? স্বল্প আয়ের মানুষও এখন গ্যাসের ভোক্তা। তাদের কথা বিবেচনায় থাকবে না? গ্যাস খাতে অনিয়ম দুর্নীতি আর লু্টপাট নতুন কিছু নয়। দাম না বাড়িয়ে এই অনিয়ম ও লুটপাট বন্ধ করা গেলেই বরং একদিকে রাষ্ট্রের বহু টাকা বেঁচে যেতো এবং জনগণও বিরক্ত হত না।
সরকার বারবারই গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে এই খাতে ভর্তুকি তথা লোকসান কমানোর কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো গ্যাস খাতে লোকসান কমাতে হলে প্রথমে এখানে অনিয়ম ও চুরি ঠেকাতে হবে। পাশাপাশি সাগর ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে হবে। কেননা দেশে আরও বেশি গ্যাসের ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে কম দামে মানুষকে গ্যাস দেয়া যাবে। এলএনজি আমদানি যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়, সে কথা এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের মানুষ যে দামে পাইপ লাইনে গ্যাস পায় তা যথেষ্ট কম। আট নয়শো টাকা দিয়ে তারা দুই তিন হাজার টাকার গ্যাস পোড়ে। আবার অনেকে আট নয়শো টাকা বিল দিলেও মাসে হয়তো পাঁচশো টাকার গ্যাসও খরচ করে না। এখানে একটা বিরাট বৈষম্য রয়ে গেছে। অর্থাৎ কিছু লোক অপচয় করে, কিছু লোক বাড়তি পয়সা দেয়। এ দুটির মধ্যে ভারসাম্য আনার একমাত্র উপায় সব বাসা-বাড়িতে প্রিপেইড মিটার স্থাপন। এতে মানুষ পয়সা বাঁচাতে হিসাব করে গ্যাস পুড়বে। প্রয়োজন ছাড়া যেমন জামা-কাপড় শুকানোর মতো কাজের জন্য কেউ আর গ্যাস জ্বালাবে না; যে যতটুকু ব্যবহার করবে, ততটুকুর পয়সা দেবে। কিন্তু সরকার কেন গ্যাসে এই প্রিপেইড মিটার কার্যকর করে না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন এবং অনুসন্ধানেরও বিষয়। তবে প্রিপেইড মিটার লাগালে সেখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও জরুরি।
৩.
এবারের বাজেটে একটা বিষয় অনালোচিত থেকে গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। তা হলো নারীদের অবশ্যপ্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাডের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ। বাজেট আলোচনায় এমপিরা বিষয়টা না তুললেও ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
কবি ও সাংবাদিক ফরিদ কবির বিষয়টা নিয়ে ফেসবুকে একটা নাতিদীর্ঘ মন্তব্য লিখেছেন, যেখানে এই স্যানিটারি প্যাডের দাম বাড়ানোর ইস্যুতে নারীমহলের নিরবতার সমালোচনা করেছেন। রসিকতা করেই তিনি লিখেছেন, এ বিষয়ে তার বউ বা কন্যাও চুপ।
ফরিদ কবির এই নিরবতার কারণ হিসেবে বলেছেন স্যানিটারি প্যাড নারীরা ব্যবহার করলেও প্রধানত এক ক্রেতা পুরুষ; হয় স্বামী হিসেবে নয়তো মেয়ের বাবা হিসেবে। যেহেতু পকেটের পয়সাটা যায় স্বামী কিংবা বাবার, অতএব নারীকুল চুপ। হতে পারে এটা রসিকতা। কিন্তু এটি নির্মম বাস্তবতাও বটে।
ফরিদ কবিরের মতো আমাকেও আমার স্ত্রীর জন্য এই প্রয়োজনীয় জিনিসটা কিনতে হয়। ফলে আমিও যখন তাকে নতুন বাজেটে এর দাম বেড়েছে জানালাম, তিনি কিছুটা দুঃখ পেয়েছেন বটে, তবে এ নিয়ে নারীকুলের নিরবতার অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার ধারণা, বিষয়টা অতি গোপনীয় কিছুটা লজ্জার বলে নারীরা হয়তো এ নিয়ে প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করতে সংকোচ বোধ করেছেন।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
এইচআর/এমএস