ভাগ্যও দরকার বাংলাদেশের
ক্রিকেট নিয়ে বাঙালির রোমান্টিসিজম পুরনো। তবে তার উত্তুঙ্গ রুপ ধরা পড়ে গত শতাব্দির শেষ দিকে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলা শুরু করলে, ক্রিকেট নিয়ে তাদের উন্মাদনা ঝাঁকুনি দিতে শুরু করে গোটা বিশ্বকে। বাংলাদেশকে এখন সবাই একটু অন্যচোখেও দেখেন। সেটা ভাল ব্রান্ডের ক্রিকেট খেলতে শুরু করার কারণে। একই সঙ্গে তাদের দর্শকদের কারণে। অন্যরা যে যেভাবেই দেখুক না কেন বাংলাদেশকে, বাঙালি নিজস্ব আয়নায় নিজেদের আবিষ্কার করছে দারুণ ক্রিকেট পাগল এক জাতি হিসেবে। যারা এখন স্বপ্ন দেখে বিশ্বকাপ জেতার। বিশ্বাস করছে ভারত এবং পাকিস্তানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে খেলবে।
আফগানরা যেভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের মেরুদণ্ড দিয়ে হিম স্রোত বইয়ে ছেড়েছে, তাতে বাঙালি কেন তাদের হারাতে পারবে না? কারণ, আফগানদের উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ তাদের সেমির স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে। আর ভারত বা পাকিস্তানকে বাংলাদেশ কখনো হারাতে পারেনি তাও নয়। তাই বাঙালির স্বপ্নটা অলীক, অবাস্তব নয়। তবে সেই স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে অন্য অনেকগুলো সমীকরণ এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যার সবগুলো মেলানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের হাতে নেই।
অনেক ‘যদি’ ‘কিন্তু’ নির্ভর সেই সব সমীকরণ। তবে এই সব ‘যদি’ ‘কিন্তু’-র বাইরে চলে গেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। জলিমন্ট স্ট্রিটে আরও একবার কাপ নিয়ে যেতে তাদের দরকার আর মাত্র দুটো ম্যাচে জয়। একটা সেমিফাইনাল। আরেকটা ফাইনাল। তবে ফাইনাল খেলা আর ফাইনাল জেতার অভ্যাস অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অস্ট্রেলিয়ার। ইংলিশদের মাটি থেকে বিশ্বকাপ জিতে নেয়া অজিদের জন্য নতুন কোন ব্যাপার নয়।
তবে অস্ট্রেলিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী স্বাগতিক ইংল্যান্ডের জন্য বিশ্বকাপ মানে এবারও হতাশা আর আক্ষেপ মেশানো এক উপাখ্যান হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইংলিশদের জন্য বিশ্বকাপ মানে সুখের বসন্ত নয়। হতাশায় মোড়ানো গ্রীষ্ম! এবারও তাদের শেষটা হতে পারে বিষণ্ণতায়। কারণ, সেমিফাইনালে যাওয়ার পথে তাদের সামনে বড় বাধা ভারত আর নিউজিল্যান্ডের মত দুই কঠিন প্রতিপক্ষ। দুই ম্যাচের যে কোন একটা হারলেই ইংলিশদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন টেমসের জলে তালিয়ে যেতে পারে। কারণ, একটা ম্যাচ জিতলে তাদের হবে দশ পয়েন্ট।
ভারত, নিউজিল্যান্ড এরই মধ্যে এগার পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষ চারের মধ্যেই আছে। আবার আফগানিস্তানকে হারিয়ে পাকিস্তান শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশের। হয়তো তারাও স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশকে হারিয়ে এগার পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনালের। তবে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান জিততে পারেনি। বরং হেরেছে। তাই ভারতকে হারালে বাংলাদেশ লর্ডসে নয়া ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন নিয়ে হাজির হবে। সেমির হাতাছানি থাকবে তাদের সামনেও।
অন্যদিকে, এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নেমে বিরল এক দৃশ্য দেখতে হতে পারে ইংলিশদের। গ্যালারিতে পাক-ভারত সমর্থকরা এক সঙ্গে চ্যাচাচ্ছেন ইংলিশদের বিপক্ষে! ইংল্যান্ডকে নিজেদের দেশে বিশ্বকাপে দর্শক বানিয়ে রাখতে, ভারত-পাকিস্তানের সমর্থকরা আজ ভুলে যেতে পারেন, সাতচল্লিশের দেশভাগের ক্ষতও! এই বিষয়টা ইংরেজদের ভেতর নড়াচড়া দিচ্ছে।
সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুইসেন তো টুইটও করে ফেলেছেন! বাঙালিরাও হয়তো খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে। তারপরও নিজেদের সমীকরণ মেলাতে তারাও চাইবেন, ইংলিশরা বিদায় নিলে প্রতিদ্বন্দ্বী একজন কমলো। আর গত বিশ্বকাপে এই বাংলাদেশই ইংরেজদের বিশ্বকাপ থেকে নক আউট করে দিয়েছিল কোয়াটার ফাইনালের আগে! তাহলে এবার তারা বাংলাদেশের আগে সেমিফাইনালের দাবিদার হয় কীভাবে! অতএব বাংলাদেশও ইংরেজ হটাও আওয়াজ তুলতে পারে এজবাস্টনে।
গত শতাব্দী হলে ইংলিশরা নিজেদের উইকেট নিয়ে খানিকটা বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কথা ভাবতে পারত। কিন্তু এখন সেটা পারছে না। কারণ, উইকেট এখন তৈরি হচ্ছে আইসিসি-র প্রেসক্রিপশনে। তা ছাড়া ইংলিশ উইকেটের চরিত্র বদল হয়েছে অনেক আগেই। গোটা পৃথিবী যখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর হুশিয়ারি পেয়েছে, ইংলিশ উইকেটের পুরোনো স্মৃতিও অস্ত গেছে।
এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেতো না। কিন্তু তাদের সেই দিন আর নেই। ক্রিকেটেও ইংরেজদের দাপট অস্তগামী। আর বিশ্বকাপে তো ইংলিশরা সাফল্যের সূর্যটাকেই দেখেনি! বিশ্বকাপ মানে ইংলিশদের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন! তাই এবারের প্রখর গ্রীষ্মেও ইংরেজদের কাপ ভাগ্য কেন যেন মনে হচ্ছে স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা!
এজবাস্টনে ভারতের কাছে ইংল্যান্ড হারলে, লর্ডসে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচটা বিশ্বকাপের পাদপ্রদীপে চলে আসবে আরো অনেক বেশি আলো ছড়াতে ছড়াতে। তবে ক্রিকেট, সে তো জীবনের মতই। চেয়েও সব সময় সব কিছু পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ চাইছে এবার সেমিফাইনালে যেতে। তবে ক্রিকেট মগজসম্পন্ন লোকও বলছেন, সেমিতে যেতে বাংলাদেশেরও একটু ভাগ্য দরকার হবে।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম