ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এই সমাজ খুনির আশ্রয়স্থল হতে পারে না

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ০১:১২ পিএম, ২৭ জুন ২০১৯

লিখতে গিয়েও কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। শিউড়ে উঠছে আমার মগজ। ভাবতে চেষ্টা করছি এও সম্ভব? এভাবেও মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব? রাস্তায় চলতে থাকা একটা বেওয়ারিশ প্রাণিকেও কি চাইলেই যে কেউ পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে? কোন সভ্য সমাজে, কোন সভ্য মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব? না।

আমি ভিডিওটি দেখিনি। দেখতে পারিনি। এখনও এতটা অমানুষ হয়ে উঠিনি হয়তো তাই ভিডিওতে ছড়ানো একটি তরতাজা তরুণকে দিনে দুপুরে পশুর মত কুপিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্যটি আমি নিতে পারছি না। আচ্ছা, যে রিফাতকে খুন করা হচ্ছিলো সে সময়টাতে চিৎকার করে করে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো যে স্ত্রী সে এখন কেমন আছে? সুস্থ আছে কি? থাকা সম্ভব?

চোখের সামনে নিজের স্বামীকে খুন হতে দেখছে নৃশংসভাবে, বাঁচানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না। আশেপাশে অনেক মানুষ ছিলো, না না। তারা কি মানুষ? কেমন করে হয়? মানুষ হলেতো আরেকজন মানুষকে খুন হতে দেখেও চুপ থাকতে পারতোনা। আর তিন চারজন মানুষও যদি এগিয়ে এসে মেয়েটাকে সাহায্য করতো তাহলেই হয়তো আটকানো যেত রিফাতের খুনি নয়ন বন্ড এবং তার খুনিদলকে।

না। আসেনি। ওরা কেউ এগিয়ে আসেনি। ভিডিও করছিলো, ছবি তুলছিলো। সেকেন্ডে সেকেন্ডে হয়তো ফেসবুকে আপডেট দিতে ব্যস্ত ছিলো। দুইমাস আগে বিয়ে হওয়া মিন্নির হাতের মেহেদি এখনও লাল টুকটুকে আছে। সেই লাল আরও লাল হয়েছে প্রিয়তম স্বামীর রক্তে।

রিফাতের বাবা অভিযোগ করেছে নয়ন এবং তার সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে তার ছেলেকে। কোন চিপা ঘুপচিতে মারেনি। সকাল দশটায় প্রকাশ্য দিবালোকে প্রকাশ্য রাস্তায় রাম দা দিয়ে খুন করেছে রিফাতকে। কান্নাকাটি অনেক হয়েছে। ফেসবুক থেকে রাস্তায় প্রতিবাদও কম হয়নি। কিন্তু ঘটনা যেন থামছেই না। একইভাবে খুন করা হয়েছিলো বিশ্বজিত নামের আরেক যুবককে। প্রকাশ্যদিবালোকে পথ আটকে রামদা কিরিচ দিয়ে রক্তাক্ত করে খুন করেছিলো। সে খুনের বিচার হয়েছে তবে সকল খুনিকে তাদের প্রাপ্য শাস্তি হয়তো নিশ্চিত করা যায়নি।

দিনের পর দিন সমাজে বেড়ে চলেছে অন্যায় ও অত্যাচারের মাত্রা। সেই তুলনায় অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে কয়টা? হিসাব করতে গেলে অনেক খাতা কলম নিয়ে বসা লাগবে কারণ ইতিহাস ঘাটতে হবে কবে কোন ঘটনায় কী শাস্তি হয়েছিলো। প্রতিদিন ঘটছে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন। মামলাও যে হচ্ছেনা তাও নয় তবে বিচার হচ্ছে কি? কয়টা ঘটনার বিচার পাচ্ছি আমরা?

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যদি নিশ্চিত না করা যায় তাহলে নয়ন বন্ডদের সাহস এভাবেই বেড়ে যাবে। অথচ বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে। আমরা ঘোষণা করছি সময়সীমাও। কতদিনের মধ্যে কোথায় পৌঁছাবো আমরা এমন ঘোষণা প্রায়শই শুনে থাকি। উন্নয়নশীল বলি আর উন্নত বলি যে কোন রাষ্ট্রেরই প্রধান শর্ত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা ও আইনের শাসন কায়েম করা।

একটি রাষ্ট্রে যদি নাগরিকের নিরাপত্তা না থাকে তবে সে রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাষ্ট্র বলা যায় কি? অপরাধ হবেই সেটাকে হয়তো “জিরো” পার্সেন্টে নামিয়ে আনা সম্ভব নয় তবে বিচার প্রক্রিয়া চালুর মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জায়গাটির দিকে যদি সরকার সক্রিয় মনোযোগ না দেয় তাহলে সরকারের অন্য যে কোন অর্জনই হয়ে পড়বে প্রশ্নবিদ্ধ।

নুসরাত হত্যার বিচার চলছে তবে নুসরাতের মত হাজারো নুসরাতের পরিবার এখনও কেঁদে চলছে কারণ সেগুলোর দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজর পড়েনি। যেকোন ঘটনা ঘটলেই আমরা দেখি একটি কমন বিবৃতি আসে। তদন্ত কমিটি হয়, মামলাও হয় তবে কিছুদিন পর সে তদন্তের আর ফলাফল পাওয়া যায় না।

দিনের পর দিন মামলার জট বেড়ে চলেছে। কিছুদিন আগে আমাদের মাননীয় আইনমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন এই দুর্বলতার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে রিফাতের খুনের ঘটনার মত যেসব ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ, ছবিসহ নানাপ্রকার বাস্তব প্রমাণ রয়েছে সে মামলাগুলো কেন দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বা হবে না? এসবক্ষেত্রে দুর্বলতা বা প্রতিবন্ধকতা কোথায় আছে? যদি কিছু থেকেও থাকে তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত সেগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়া।

এসব পদক্ষেপ নিতে আসলে দরকার একটি ইতিবাচক মনোভাব আর কিছুই না। আমরা জানি এই সরকার আইনের শাসন কায়েমে বদ্ধপরিকর। যেকোন অন্যায় অবহেলা বা দুর্নীতিকে রুখে দিতে “জিরো” টলারেন্স নীতিতে যাওয়ার ঘোষণাও এসেছে। যদি সেটাই হয় তাহলে আমরা জনগণ অতিসত্ত্বর রিফাতের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।

এই ঘটনার সমস্ত অ্যাভিডেন্স এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সুতরাং আমাদের তদন্তকারী টিমের কাজ অনেকাংশেই কমে গিয়েছে বলেই মনে করছি। সুতরাং রিফাত হত্যার বিচারের স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় ফেলে রাখার যৌক্তিকতা আমাদের নাগরিকের মনে আশংকাই বাড়াবে প্রশান্তি দিবেনা কোনভাবেই।

একটি প্রশ্ন আমি কোনভাবেই মন থেকে তাড়াতে পারছি না। এই যে নয়ন নামে ছেলেটি যেকোন কারণেই হোক প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে খুনের সিদ্ধান্ত নিলো এর পিছনে তাকে শক্তি যোগালো কোন বিষয়টা? একজন মানুষকে খুন করে ফেলার বাসনা জাগা কোন স্বাভাবিক মানসিকতা নয়। তার পারিবারিক বা রাজনৈতিক কোন পরিচয় এখনও কেউ সামনে আনেনি। তারমানে সে সাধারণ ঘরেরই সন্তান। তাহলে খুন করলে সেও কি রক্ষা পাবে? তারতো ফাঁসিও হতে পারে। এই ভয় কেন তার মনে কাজ করলো না? অনেক ভেবেছি সংবাদটি পড়ার পর থেকে। ভেবেছি ছেলেটি কি মানসিকভাবে অসুস্থ? ধরে নিলাম ছেলেটি অসুস্থ কিন্তু তার পাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলো? যারা সাক্ষী হয়ে রইলো সেই নৃশংস ঘটনার তারা? তারা কেন সঙ্গ দিলো এই খুনের? কোন মানসিকতা তাদেরকে উৎসাহিত করলো প্রতিবাদ না করে ভিডিও বা ছবি তুলতে?

উত্তর একটাই পেলাম ভিতর থেকে। একটি রাষ্ট্রে যখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত থাকে তখন এভাবেই খুনের মত কাজও হয়ে উঠে সহজ কাজ। কারণ এর আগে তারা দেখেছে শত শত খুনের বিচার হয়নি। দিব্বি সুন্দরভাবেই বেঁচে আছে এবং সামাজিক জীবনযাপন করছে। সুতরাং, প্রতিশোধের উপায় হিসাবে খুন এখন কোন কঠিন কাজ নয় বা অপরাধও নয়।

এভাবেই দিনে দিনে খুনিরা প্রশ্রয় পায় আর সমাজ হয়ে উঠে অসহায়। বিচারের বাণী যেখানে নিভৃতে কাঁদতে থাকে। জানিনা রিফাত হত্যার বিচার আমরা পাবো কি না। তবে যতদিন বেঁচে আছি একটি খুনও জায়েজ হবে না এই আশা নিয়েই বাঁচতে চাই। এই সমাজ খুনের আশ্রয়স্থল হতে পারে না।

লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন