ইতিহাসের সত্য : প্রসঙ্গ কথা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর রজতজয়ন্তী উৎসব পালনের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি এবং তাতে জাতির পিতা ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে তর্কবিতর্ক শুরু হওয়াটা একটুও পছন্দ হচ্ছে না। বরং উল্টাপাল্টা নানা কথায় উদ্বিগ্ন হচ্ছি। অবশ্য এটাও ভাবি যে, আইনের আওতায় বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা হচ্ছে সাংবিধানিক অধিকার আর রাজনীতি থাকলে রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে তর্কবিতর্ক হবেই।
বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কবিগুরু এসে দেখে যাও বাঙালি মানুষ হয়েছে। কিন্তু এটাই বিধিলিপি যে আমরা এমন মানুষ হয়েছি, যাতে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর শাসনামলে খোদ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়েই তর্কবিতর্ক বাধে আর হত্যা-ক্যু-সামরিক আইনের রাজনীতি শুরুর পর রাষ্ট্রক্ষমতা থেকেই আক্রমণাত্মক ভাষায় বলা হতে থাকে, পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে আমরা ভারতের পরাধীন হয়েছিলাম।
রাজনীতিতে ইতিহাস নিয়ে যত তর্কবিতর্কই বাঁধুক, ইতিহাসের অমোঘ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এমন, যাতে তা ক্রমাগত সত্য খুঁজে নেয়। বর্তমানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, মহলবিশেষের ভেতরে ভেতরে ওই বিষয়ে কার কী মত রয়েছে জানি না, তবে প্রকাশ্যে ওই ধরনের আক্রমণাত্মক প্রচার আর সামনে আনা হয় না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত বাম-ডান-মধ্য থেকে যতভাবে স্বাধীনতার ইতিহাস মিথ্যা ও বিকৃত করা হয়েছে, তার টার্গেট হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ। এর কারণ হলো বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে বা বলতে গেলে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার ইতিহাস আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস লিখতে গেলে বাংলাদেশের ইতিহাস উঠে আসে। এই দুই ইতিহাস আছে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে; একটা থেকে অপরটা পৃথক করা অসম্ভব। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বলতেন, লোকে শেওড়া গাছে ঢিল মারে না, মারে আম গাছে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু তাই আমাদের রাজনীতিতে টার্গেট হয়েই আছেন।
প্রসঙ্গত, সুদিনে বা দুর্দিনে, ক্ষমতা বা বিরোধী দলে যখনই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে টার্গেট করে এদিক-ওদিক মিথ্যা ও বিকৃত প্রচারণা চলতে থাকে; তখন স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উত্তর দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের উত্তর প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে বিজ্ঞানের এক নিয়মের কথা। বাস্তবে এক প্রান্তে যখন কোনো কিছুকে হেলানো হয়, তখন অন্য প্রান্ত উল্টো দিকে হেলে পড়ে। তদুপরি রাজনীতি অঙ্গনের বক্তব্য কখনো সীমারেখায় আটকে রাখা যায় না। ফুলানো-ফাঁপানো কথা রাজনীতির অনুষঙ্গ। তাই রাজনীতিতে উত্থাপিত ইতিহাসের সঙ্গে ইতিহাস অনুসন্ধান ও চর্চার পার্থক্য ও সংঘাত সব সময়েই বিরাজমান। আওয়ামী লীগ ও নেতাদের বক্তব্যের এই দিকটি বিবেচনায় নিয়েই দেখতে হবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কথায়-কাজে কখনো ইতিহাসকে বিকৃত করতে চাননি। স্বাধীনতার ইতিহাসে বাম কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমার আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল পার্টির কর্মীগণ বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রয়েছে। … আপনাদের পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে পার্টি কর্মীদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে। … ১৯৬২-৬৩ সালে, তারও আগে জেল থেকে বের হয়ে আসার পর অনেক সময় রাতের অন্ধকারে গোপনে কোনো এক জায়গায় আশ্রয় নিয়ে কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে অনেকবার। … আপনারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন।’ প্রশ্ন হলো মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস নিয়ে রাজনীতির টানাপড়েন ও ডামাডোলের মধ্যে আওয়ামী লীগ কি বঙ্গবন্ধুর পথে ওই উদারতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে? বর্তমান দিনগুলোতেও আওয়ামী লীগ নেতা কারো কারো মধ্যে ‘সব আমরা করেছি’ বলে বক্তব্য প্রদানের প্রবণতা রয়েছে।
একটা কথা কিন্তু আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের স্মরণে রাখতেই হবে যে, স্বাধীনতার আগে বা পরেও ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা বা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ যখন বিপাকে পড়েছে, তখন একা তা থেকে মুক্ত হয়ে আবার ফিনিক্স পাখির মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। পাকিস্তানি আমলে ১৯৬২ সালে ক্ষমতার প্রশ্নে সেনাশাসক আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন গ্রেপ্তার হন কিংবা আগরতলা মামলার পর শেখ মুজিবসহ তৃণমূলের নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ায় আওয়ামী লীগ যখন চরম নির্যাতনের মধ্যে কিংবা বাংলাদেশ আমলে যখন দেশ হত্যা-ক্যু-প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের অক্টোপাসের জালে আটকা পড়ে, তখন ছোট ছোট দলগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে। একা কেউ টিকতে কিংবা বিজয় ধরে রাখতে পারে না। মিত্র সব সময়েই প্রয়োজন। হাতি-পিঁপড়া, হাতি-তেলাপোকার গল্প কিন্তু এখনো রাজনীতির আলোচনায় আসছে।
দেশের রাজনীতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোধকরি কোনো দল ও ব্যক্তির তুলনা করা বালখিল্যতা এবং যিনি বা যে দল করবে, তার স্থান হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। পাকিস্তানের রাজনীতির ১৪ বছরের নিদারুণ অভিজ্ঞতা থেকে ১৯৬১ সালে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম অন্য বা নিজ দলের নেতাদের স্বাধীনতার কথাটি বলেন। মণি সিংহ-খোকা রায়ের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে গোপন বৈঠকে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘ভাই, এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতা (সোহরাওয়ার্দী) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল।’
কথা মেনে নেয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার ইস্যু নিয়ে কাজে তিনি সেটা যে মেনে নেননি তা সুস্পষ্ট। আগরতলা যাওয়ার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতৃস্থানীয় কর্মী তাকে গোপনে আখাউড়া পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তাই বলা যায় কথা বললেও তিনি বা মণি সিংহ স্বাধীনতার বিষয়টি সেলফে তুলে রাখেননি। নতুবা ছাত্র ইউনিয়নের দুজন তার ওই উদ্যোগের সাথী হয়েছিলেন কীভাবে? আগরতলায় গিয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তা অব্যাহত রেখেছেন। প্রসঙ্গত, ওই ঐতিহাসিক সভাতেই ঠিক হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬১ রাতে ইস্কাটনের এক বাড়িতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় (কমিউনিস্টরা ছিল গোপন কাজে সিদ্ধহস্ত, তাই এটাই ছিল স্বাভাবিক) দুই ছাত্র সংগঠনের বৈঠক হয়েছিল। ৩০-৩৫ জনের ওই বৈঠক সফল করতে মোহাম্মদ ফরহাদের সহযোগী ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি। সিরাজুল আলম খান ওই বৈঠকে ছিলেন কিনা জানতে পারিনি। স্মৃতি সব সময়েই প্রতারক এবং ব্যতিক্রম বাদে স্মৃতিকথায় প্রত্যেকেই নায়ক হতে চান। তবে এটাই সত্য, দুই বছর পর ১৯৬৩-৬৫ সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার চিন্তা কথা ও কাজের সঙ্গে কারো তুলনা করা অবান্তর ও হাস্যকর। বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ হচ্ছে মহীরুহ। তিনি স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা ও রূপকার। তার স্নেহের ছাতার ছায়ায় ছিলেন ছাত্রনেতারা সবাই। আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত হয়ে ইতিহাসের মহানায়ক যখন পাকিস্তানে যান, তখন স্লোগান ওঠে, ‘পূর্ব পাকিস্তান এসেছে’।
কোথায় উদার আকাশ আর কোথায় কল্পনার পাতাল। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি অস্ত্র আনতে গিয়ে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছিলেন। আর ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে গ্রুপ আর নিউক্লিয়াস যা-ই সৃষ্টি হোক না কেন, সবই হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, জানার মধ্যে। প্রসঙ্গত, রাজনীতিতে সব সময়েই দুই মেরু সৃষ্টি হয় এবং যিনি নেতা তিনি হন ভারসাম্যের প্রতীক। প্রকৃতির নিয়মে পাখির যেমন থাকে দুই ডানা, বাঁশির সুরের যেমন থাকে ওঠানামা, তেমনি নেতারও থাকে দুই বাহু। রাজনীতি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের বিষয় বিধায় নেতা যখন যেটা দরকার তখন সেটা ব্যবহার করেন। এই বিচারে ছাত্রলীগে স্বাধীনতার বিরোধীরা যেমন ছিলেন তেমনি পক্ষেরও ছিলেন। দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করে ঐক্যের ভেতর দিয়েই আসে ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ। নেতা তাতে নেতৃত্ব দেন। আবার শুরু হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এটাই ইতিহাসের নিয়তি। এই বিচারে চরমতম ঘৃণ্য ও আঁস্তাকুড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা বিপক্ষ শক্তিরও ঘটনার অগ্রগতিতে একটা ভূমিকা থাকে। বঙ্গবন্ধু গল্পকথার হ্যামিলনের বাঁশিওয়ার মতো ছিলেন বলেই জনগণের হৃদয়মন জয় করে জাতির পিতা হতে পেরেছিলেন।
ক্ষুদ্র এ কলামে সবশেষে প্রশ্ন, আমাদের মহান স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা করবে কে? কখন রচিত হবে এই ইতিহাস? সাধারণভাবে ইতিহাস অনুসন্ধান ও চর্চার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। ক্ষমতার চারপাশে ঘুরঘুর করা স্তাবকরা অনেক সময়েই দিনকে রাত করে। আর অন্ধ কূপমণ্ডূক ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিরা সব সময়েই থাকে ইতিহাসকে বিকৃত করার কুমতলবে। তাই কবিগুরুর কথা মনে করে বলতে হয়, ‘যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/পশ্চাতে রেখেছে যারে সে তোমাকে পশ্চাতে টানিছে।’ আমাদের ইতিহাসের তথ্যভাণ্ডার রয়েছে সর্বোতভাবেই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পক্ষে।
উল্লেখ্য, ইতিহাসের গভীরে যেহেতু রয়েছে জাতির শিকড়, তাই রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই ইতিহাসকে করে প্রভাবিত। আর ভারত উপমহাদেশের তিন দেশ বিশেষত আমাদের দেশের রাজনীতিতে ইতিহাস সবসময়েই বড় এক ফ্যাক্টর। তাই প্রকৃত ইতিহাস উঠে এলে আমাদের জাতি আর সেই সঙ্গে প্রধান গণআস্থাসম্পন্ন আওয়ামী লীগই হবে সবচেয়ে উপকৃত ও নন্দিত। প্রকৃত বিচারে ইতিহাসের সত্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের হারানোর কিছুই নেই, জয় করার জন্য আছে মানুষের হৃদয় ও আগামী দিনের ইতিহাস।
এখন আওয়ামী লীগ সরকার রয়েছে ক্ষমতায়। এটাই সুবর্ণ সুযোগ। সরকার সব জনগণের আর দল আওয়ামী লীগ সদস্যদের। সরকার ও দল অবশ্যই পৃথক আবার সরকার ও দলের মধ্যে রয়েছে জনগণ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সরকার যদি চায় তবে স্বাধীনতার ইতিহাসের সব দলমতের সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আমাদের প্রকৃত ইতিহাস জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে। এটা ঠিক, এমনটা করলেও বিতর্ক বাধবে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর শততম বার্ষিকী ও স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসব পালনের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ যদি এই কাজে অগ্রসর হতে পারে, তবে সেটাই হবে জাতির জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের বড় এক উপহার।
লেখক : রাজনীতিক।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম