দুর্নীতি: বড় ঘটনার বড় বিচার
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে দুদক। তদন্ত চলাকালে তদন্তাধীন তথ্য অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে তার অভিযোগ তদন্তকারী কর্মকর্তা এনামুল বাছিরের তথ্য জানানোর মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী তাকে সাময়িক বরখাস্তের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইসঙ্গে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
গত বছর নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয় পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানকে। এরপর তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য প্রকাশ হলে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক। এই তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। তবে তদন্ত চলাকালেই প্রাপ্ত তথ্য অভিযুক্তের কাছে চালান করে দিয়ে আপসরফার মাধ্যমে দুই দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন তিনি। ডিআইজি মিজান নিজেই এমন অভিযোগ করেছেন দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে।
এনামুল বাছির সত্যি টাকা নিয়েছেন কিনা, কথিত ফোন রেকর্ডের কণ্ঠ তার কিনা, সেগুলো প্রমাণ করা সময় সাপেক্ষ। কিন্তু দুদক চেয়ারম্যান যতই বলুন না কেন যে, ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নিবেনা, মানুষ ততটা আশাবাদী হতে চায়না। মূল প্রশ্ন নৈতিকতার। দুদক কর্মকর্তাদের কাছে প্রত্যাশা বেশি। তাই সামান্য বিচ্যুতিতেও মানুষ হতাশ হয়। যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হবে, এনামুল বাছিরের অপরাধ সামান্য নয়। এবং এমন কত বাছির সংস্থায় রয়ে গেছে তা নিয়েও প্রশ্ন করছে মানুষ।
দুর্নীতির সাথে শাসন ব্যবস্থার সম্পর্ক আছে। গত বছর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে এবং পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বারবার বলার চেষ্টা করেছে, উন্নয়নের পাশাপাশি এবার সুশাসন নিশ্চিত করাই দলের বড় এজেন্ডা। সুশাসন মানেই সততার শাসন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টির উল্লেখ ছিল। নির্বাচনের পর বলা হয়েছিল দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। নিচুতলা থেকে উপরতলা, যে দলেই হোক— দুর্নীতি করলে কেউ রেহাই পাবেন না।
সেটি এখন দেখার পালা। তবে এটাও ঠিক যে, মূল্যায়নের সময় চলে যায়নি। নতুন করে সরকার গঠনের এক বছরও হয়নি এখনো। দুর্নীতির সাথে রাজনীতির সম্পর্ক সরাসরি। এখানে দলগুলোর নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন যে, তারা সংসদে যখন প্রার্থী-বাছাই করে তখন টাকাওয়ালা প্রার্থী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না বহু বছর ধরে। এর বাইরে পেশিশক্তি আছে এমন বিবেচনায় দাগি দুষ্কৃতীকারীও দলীয় টিকিট পেয়ে যায়। এই প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াতেই একটি দল কেমন শাসন ব্যবস্থা উপহার দিবে, তাদের অগ্রাধিকার নির্ণীত হয়ে যায়। বোঝা যায়, সেই অগ্রাধিকারের তালিকায় রাজনৈতিক নৈতিকতার কোনও স্থান নাই।
রাজনীতি যখন এমন পথে চলে, তখন প্রশাসনিক স্তরে থাকা লোকজন বড় সুযোগটি নেয়। ব্যক্তি-রাজনীতিকের লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে দল ও সংগঠনের তরফে নৈতিকতা বিসর্জনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুশীলনের বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়। জনসমাজও প্রায়শই এই ধরনের দাগিদের প্রত্যাখ্যান বা নির্বাসিত করে না, বরং সাদরে-সমাদরে মাথায় তুলে আনে। এ কারণেই সমাজের সর্বত্র দুর্নীতিবাজের যাত্রাপথে পুষ্পবৃষ্টি হয়। জনসমাজও এখন সংকীর্ণ পচনশীল স্বার্থপরতায় আপ্লুত। এই পথ ধরেই মিজান আর বাছির সৃষ্টি হয়।
একটা কথা ঠিক যে, দুর্নীতি সমূলে উচ্ছেদ করা অসম্ভব বরং নিয়ন্ত্রণে সুফল মিলতে পারে। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে দুর্নীতি। সম্প্রতি উদ্ঘাটিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশ কাহিনী সবার জানা। এর আগে বেসিক ব্যাংক লোপাট হওয়া, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারির কথাও জানি আমরা। সর্বস্তরেই কেচ্ছা ও কেলেঙ্কারি ও অনাচারের দুঃশাসনীয় হার ইদানীং বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছানোয় দুর্নীতির ব্যাপ্তির প্রশ্নটির প্রতি নতুন করে গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে।
এই যে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি, তার মোকাবিলা কিভাবে করা যাবে সেটাই প্রশ্ন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঠিক থাকলে, সততাকে উৎসাহিত করলে বড় একটি বড় পথ সৃষ্টি হবে। কার্যক্ষেত্রে দায়িত্বে যারা থাকেন তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ক্ষমতা অপব্যবহারের প্রকরণে পরিণত করে ফেলেন। সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভ্রষ্টাচার মোকাবিলায় অর্গানাইজড ক্রাইম দমন করার পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে। এই সরকারের আমলে শেয়ার বাজার কেলেংকারি ও ব্যাংকের কিছু ঘটনার প্রকৃতি এই অর্গানাইজড ক্রাইম ধরনের। অর্থমন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো সামান্যতম সতর্ক ও সক্রিয় হলে অনায়াসে এসব ঠেকানো যেত। ঘটনা ঘটার পরও মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রণসংস্থাগুলোর সক্রিয়তা আমরা দেখিনি।
দুর্নীতি ও তার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রয়োজন দুর্নীতিকে অস্বীকার না করার প্রবণতা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘ধারণা সূচক’ রিপোর্টে আমাদের দেশের যে চিত্র উঠে আসে, কিংবা নানা সময় সংস্থাটি বিভিন্ন বিভাগের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে যে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপিত করে, এগুলোকে এক কথায় উড়িয়ে না দিয়ে একটু খতিয়ে দেখার মানসিকতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
আর্থিক খাতসহ নানা কেলেঙ্কারি যা ঘটেছে, তা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির শোচনীয় ব্যর্থতাই বলতে হবে। কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের ঘটনায় জোরালো ধাক্কা খেয়েছে প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি। তবুও বলব দুর্নীতি যেন রাজনৈতিক বিতর্ক হয়ে না দাঁড়ায়। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিতর্ক করে জিততে চাইলে ক্ষমতা ও দুর্নীতি সমার্থক হয়ে জটিল আকার ধারণ করবে। বড় ঘটনার বড় বিচার হলেই দুর্নীতি বিরোধী বড় মনোভাব সমাজে সৃষ্টি করা সম্ভব।
এইচআর/জেআইএম