মানুষের ভালোবাসাই একমাত্র ক্ষমতা বিপ্লব সরকারের
০১৭১৩৩৭৩১৭৫ একটি সরকারি নাম্বার। নাম্বারটি এ শহরে পরিচিত অনেকেরই। শুধু পরিচিত নয়, অনেকেরই মুখস্থ নাম্বারটি। মোবাইল নাম্বার সহজে মুখস্থ করে না লোকে। করে খুব আপন, কাছের, পরিচিত আর প্রয়োজনীয় হলে। নাম্বারটি বিপ্লব সরকারের। পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব। তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার। বিপ্লব একটি বিশাল এলাকার মানুষের কাছে ‘আপনজন’ হয়ে উঠেছেন নিজের সততা, মেধা আর দিনমান পরিশ্রম দিয়ে। বিপ্লবের কাছে চেনা-অচেনা, পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য লোকের আনাগোনা শুধু ন্যায্য আইনি সহায়তা, পুলিশি সেবা দেওয়ার কারণেই।
আমি তখন নাঈমুল ইসলাম খান প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক কাগজ’ সম্পাদক। কাগজ এর পূর্ববর্তী সম্পাদক খালেদ মুহিউদ্দিনের খুব ইচ্ছা কাগজ বিশেষ সংখ্যা করবে। আমাকে দায়িত্ব দেয়ার সময়ও খালেদ মুহিউদ্দিন বারবার বলেছেন, জব্বার, সাপ্তাহিক ২০০০ এ থাকতে যেমন বিশেষ সংখ্যা করেছেন, এখানেও দেখতে চাই এমন। আমার জন্য প্রথম সম্পাদক হয়েই বিশেষ সংখ্যা করা সত্যিই চ্যালেঞ্জ ছিল।
বিশেষ সংখ্যা মানেই বর্ধিত কলেবরে ঢাউস সংখ্যা। সিনিয়র লেখক, কলামিস্টদের একগাদা লেখায় ঠাসা- এই ফর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইলাম। হঠাৎ মনে হলো, এতো কম বয়সের একজন তরুণ, আমি সম্পাদক হলাম, আমার তো উচিত দেশের এগিয়ে যাওয়ায় যে তরুণরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে তাদের কথা তুলে ধরা। সম্পাদকীয় বিভাগের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অংশ যে তরুণরা, এমন সাতজন তরুণের সংগ্রাম, স্বপ্নে সাজবে কাগজ বিশেষ সংখ্যা। সেই সময়ের তরুণ সংসদ সদস্য, বর্তমান যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের পরিচালক কানতারা খানসহ আরো অনেকেরই সাক্ষাৎকার ছিল। সবার কথা এখন মনেও নেই। তবে মনে আছে তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব সরকারের সাক্ষাৎকারটি আমি নিজেই নিয়েছিলাম।
নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন আমাকে বলেছিলেন, আপনার সাথে কথা বলে আনন্দ পাওয়া গেল। সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, তার জীবনে সেরা সাক্ষাৎকার নাকি আমার নেওয়া, ড. হুমায়ুন আজাদ আমাকে চমকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যে কেউ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এখনো বলেন, তোমার সঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রস্তুতি নিয়ে বসতে হয়।
এমন অভিজ্ঞতা আমার অনেক দিনের, নতুন নয়। একটা সময় সাক্ষাৎকার নিতে ভীষণ ভালো লাগতো। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, আত্মজৈবনিক সব ধরনের সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারে ভেতরের মানুষটাকে আবিষ্কার করা যায়।
দিনক্ষণ ঠিক হলো। আমার শর্ত ছিল সাক্ষাৎকারের সময় আর কেউ থাকবে না, আমার কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়। শুধু দুটো রেকর্ড হবে, একটি তার কাছে অন্যটি আমার। ডেইলি স্টারে তাকে নিয়ে ফিচার স্টোরি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আগেই-‘হিরো অব আওয়ার টাইম’। কথা চলতে থাকে, ঘন্টা পেরিয়ে যায়। আমি অন্য এক বিপ্লব সরকারকে আবিষ্কার করতে থাকি। বেরিয়ে আসতে থাকে তার প্রত্নআদল। পোশাকের বাইরে এক অন্য মানুষ। সংগ্রামী এক যুবক। সততা যার আশ্রয়। মেধা যার সম্বল। জয় বাংলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার অবলম্বন। রেকর্ড চলতে থাকে, বিপ্লব বলতে থাকেন। নিজেকে কী করে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন শিক্ষক বাবার নীতি আদর্শে। বাবা বলতেন, মানুষের পাশে থেকো, কখনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিও না।
সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল কাগজ বিশেষ সংখ্যায়। প্রথম মুদ্রণ ২০,০০০ কপি নিঃশেষ হয়েছিল প্রথম দুদিনেই। আবার দ্বিতীয় মুদ্রণ করতে হয়েছিল কাগজ। দেশ-বিদেশ থেকে ফোন, ই-মেইল, অভিনন্দন পাঠকদের। এমন ‘হিরো’ পুলিশই চাই দেশে। এমন পুলিশই প্রয়োজন।
বিপ্লবের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই, দেখা নেই, সাক্ষাৎ নেই। যোগাযোগ রাখি না আমি নিজেই। আবার নতুন মানুষ, নতুন কারো সঙ্গে পরিচয়, সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহী হই। আমার কাজের ধরনটাই হয়তো এমন। তবে যোগাযোগ না থাকলেও ভেতরে ভেতরে একটা টানবোধ করি। সৎ, সাহসী আর মেধাবী মানুষের প্রতি এই টানটা আমার আত্মিক, স্বভাবজাত, চিরকালীন।
পাঠকরা যে ‘হিরো’ বলেছিলেন তাকে, একজন বিপ্লব সরকার কিন্তু সত্যিই সে হিরো হয়েছেন। তা না হলে একজন লোক ২৩ বারের মতো ডিএমপি’র শ্রেষ্ঠ ডিসি হয় কী করে? আর সাহস-সততা ধারণ না করলে কি করে আইজিপি’র সামনে বলা সম্ভব- ‘রেঞ্জ ডিআইজিরা ওসি পদায়নে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে ঘুষ নেন। আবার পুলিশ সুপাররাই এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল পদায়নে ঘুষ নেন। ফলে এ ঘুষের টাকা উঠাতে গিয়ে ওসি থেকে শুরু করে নিচের পদের সদস্যরা মাদক বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ফলে মাদকবাণিজ্য বন্ধ করা যায় না। মাদক বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে ওসি থেকে নিন্মপদে কর্মরতদের পদায়নে ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।’
ক’ দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে তোলপাড়। শুনেছি হঠাৎ করেই বিপ্লব সরকারকে সুদূর রংপুরে বদলি করা হয়েছে। যে ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে লড়াই করে যাচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে। রক্তাক্ত হয়েছে, কারাবরণ করেছে, শিক্ষা ও চাকরী জীবন যার ব্যাহত হয়েছে মেধা তালিকায় থাকবার পরও। হঠাৎ করে তার কর্মস্থল পরিবর্তন মেনে না নিতে পারাটাই স্বাভাবিক অনেকের। অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন। কেউ কেউ মানববন্ধন করতে চেয়েছেন। কিন্তু সেটা বিপ্লবই হতে দেননি, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এই ভেবে।
খবরের কাগজ খুললে, অনলাইন ক্লিক করলেই পুলিশের অসংখ্য নেতিবাচক খবর। অসভ্য, নোংরা, অশ্লীল কাজকর্মে জড়াচ্ছে পুলিশ। কেউ মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, কেউ নিজেই নারী উৎপীড়ক, ধর্ষক, কেউ হয়তো অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক। কোন লাজ-লজ্জা নেই, ভাবলেশ নেই। অনেকেই মানি পারভার্ট, সেক্স পারভার্ট- সাইকো। বিশাল এই ডিপার্টমেন্টের প্রতি ন্যূনতম সম্মানও নেই, যায় আসে না কোনও।
আমি আশাবাদী মানুষ। সব কিছুর মধ্যেই ভালোটা খুঁজতে, দেখতে ভালোবাসি। তবে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলাও আমার স্বভাবজাত। পুলিশের এতো নেতিবাচক ইমেজের মাঝেও একজন বিপ্লব সরকারের জন্য সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা, তার এলাকা ও সামাজিক মাধ্যম জুড়ে, সেটাও অনেক বড় ঘটনা। অনেকেই মনে করেন, বিপ্লব সরকার, সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থক, যার কারণে তিনি অনেক ক্ষমতাবান। আসলে কিন্তু তা নয়। সততার চেয়ে বড় কিছু নেই। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে কিছুই বড় নয়। বিপ্লব সরকার ভালোভাবেই সেটা জানেন, সে কারণেই তিনি মানুষের কাছে জনপ্রিয়।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/পিআর