নারী : দরজার ওপাশে উঁকি দিন
বেশ কয়েকমাস হলো একটা বিষয় নিয়ে লিখবো লিখবো ভাবছিলাম , কিন্তু লিখতে গেলেই ইতস্তত বোধ করছিলাম। কারণটাও জানা আছে কিন্তু Confess করতে মনে সায় দিচ্ছে না। তবে, আমি আমার যেই বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায়ই বিরক্ত হই তা হলো কোন জিনিস মাথার ভিতর ঢুকলে তা Execute না করা পর্যন্ত শান্তি পাইনা । দিন রাত যেকোনো কাজের ফাঁকে ঐ Particular subjectটি মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। পাঠকেরা নিশ্চই এতক্ষণে বলবেন ,’’ এতো কথা ঘুরাচ্ছেন কেন? আসল কথা বলে ফেললেই হয়।’’ হা হা হা… জ্বি জ্বি বলছি বলছি ।
আমরা যাই বলি না কেন বা যাই উপস্থাপন করি না কেন নিজের জীবনের ছোটবড় অভিজ্ঞতা থেকেই বলি বা করি। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাই না? তাই আমার কথা/ লেখার বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়ারল্যান্ড বা বাংলাদেশকে ঘিরেই থাকে। উদাহরণগুলো চলেই আসে তাদের মধ্যে থেকেই। না চাইলেও কিছু তুলনাও চোখে পড়বেই।
এই যে, আমিসহ আপনারাও বছরের পর বছর হয়তো লক্ষ্য করেছেন, আমরা বাঙালিরা যখন যেকোন অনুষ্ঠানে যখন একত্রিত হই, তখন দেখবেন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাই। পুরুষরা একদিকে, মহিলারা এক দিকে। এই ভাগাভাগি বয়স ভিত্তিতে আরও শাখা-প্রশাখা গজায়। বিষয়টি এমন যে, সমষ্টিগত সবার জন্য কমন কোন গ্রাইন্ড বা টপিক নেই কথা বলার। জানি বা মেনে নিচ্ছি, হয়তো নারী ও পুরুষের ইন্টারেস্ট এর গ্রাউন্ড ভিন্ন থাকায় বিষয়টি এমন হয়ে থাকতে পারে। অনেকেই বলবেন ‘হয়তো’ কি , এটাই আসলে। কিন্তু আমি ‘হয়তো’ শব্দটা আমার জন্য ব্যাবহার করেছি কারণ আমার কখনই ভালো লাগতো না দুইভাগে ভাগ হতে।
আমার ভালো লাগতো না এবং আজ অব্দি লাগেনা , নারীদের তথাকথিত কিছু Typical টপিক নিয়ে কথা বলতে, এই ধরুন কার ড্রেস/ শাড়ির দাম কতো, কার স্বামী/ প্রেমিক কি উপহার দিলো , কি রান্না হলো আর বাচ্চা থাকে ‘’ ওর বাবা হেন করছে , তেন করছে’’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ( জানি অনেকেই হয়তো এতক্ষণে আমার উপর বিরক্ত )। এসব কথায় আমার গা জ্বললেও দাঁত-মুখ খিচে মুখে হাসি রেখে শুনতাম, শুনে এসছি।
আমি দেখছি, আসলেই এই ধরনের কথোপকথনে উনারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিচ্ছেন, উনাদের এর বাইরে যেনো কথা বলার আর কোন টপিক নেই। আমি উত্তর খুঁজতে থাকি , আমি/ আমরা এই ধরনের কনভারসেসন থেকে কি শিখছি, কি পাচ্ছি, কোন কাজে লাগবে? বিনোদন? দুঃখিত আমি বিনোদিত হতে পারিনা। হয়তো কি এই কারণে আমার কোন মেয়ে বান্ধবী নেই? ভাবনা টুকু মস্তিষ্কের পিছনের ফোল্ডারে ফেলে, আমি চলে যাই পুরুষ গ্রুপের মাঝে , উনারা উনাদের জ্ঞানের ব্যাসার্ধ ও মতাদর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে গল্প, ডিসকাশন করছেন।
কেউ করছেন চলমান ব্যবসা নিয়ে বা রাজনীতি নিয়ে বা কেউ নিজের চাকরি নিয়ে। উনারা যার যার মতো কথা বলে যাচ্ছেন আর আমি শুধু শুনেই যাচ্ছি ঠিক একটা মূর্তির মতো। আমি উনাদের কথা ও বিষয়বস্তু বোঝার চেষ্টা করি, বেশিরভাগই বুঝে উঠতে পারি না, একে তো কথার মাঝে ঢুকেছি , তারমধ্যে কিছু বিষয় হয়তো আমার জানার পরিসীমার বাইরে। কিন্তু আমি তো জানতেই চাই, শিখতেই চাই। কিন্তু কেউ আমার সাথে Interact করছে না, আমার দিকেও তাকাচ্ছে না।
অর্থাৎ আমাকে উনাদের মূল আলাপে Include করছে না। তাহলে কি উনারা কি ধরেই নিয়েছেন ,মেয়ে মানুষের এসব কথার আর কি বুঝবে? বা মেয়ে মানুষ কম বোঝাই ভালো ? নাকি এতো গভীর তত্ত্ব বোঝার নারীদের অনুকূলে নেই? কোনটা? অনেক সময় উনারা সামান্য হ্যালো/ সালাম বলে আমন্ত্রণ জানানোটাও প্রয়োজন মনে করেন না। আমি কোণায়ই বসে রই আমার তবুও মনে হয়, যদি নতুন কিছু একটা জানতে পারি আজ… আমি শুনে যাই… দেখে যাই ...।
নাহ, আমি আজ সম অধিকার চাইতে এই পয়েন্টে কথা বলতে আসিনি ।
পরের উদাহরণে যাচ্ছি এবার, আইরিশরা যখন কোন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে বা খাওয়ার টেবিলে বা কফির আড্ডায় বা যেকোনো জায়গায় একত্রিত হয়, তখন নারী- পুরুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয় না। ওরা সবাই বিভিন্ন বয়েসের নারী- পুরুষ একই সাথে একই স্থানে থাকেন। এমন এক বিষয়ে উনারা আলাপ চালিয়ে নেন যেটাতে সবাই Involve হতে পারে, সবার যার যার মতামত জানায়, অভিজ্ঞতা যায়, জ্ঞ্যান Sharing হচ্ছে, কেউ নতুন কিছু জানছে , শিখছে , সবাই সেই আলাপে Participate করছে।
আলাপ ও Interesting হতে থাকে। ধরুন, উনাদের আলাপ বা আড্ডার মাঝে আপনি ঢুকে গিয়ে বসলেন। সেটা যেই বিষয়ে আলাপ চলুক না কেন , ঐ গ্রুপের থেকে একজন কি নিয়ে আলাপ চলছে তার একটা ব্রিফ/ ধারণা দিয়ে দিবে আস্তে করে। যদি আপনার সাথে পরিচয় না থেকে থাকে, তাহলে হ্যালো’ বলে নিজের পরিচয় দিয়ে,আপনার সাথে পরিচিত হয়ে নিবে। যদি আপনার ঐ বিষয়ে কোন আইডিয়া না থাকে তাহলে আরেকটু সূচনা দিয়ে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। অর্থাৎ ওরা মন থেকে চেষ্টা করবে যে, আপনি বিষয়বস্তুটি বোঝেন এবং যেনো কোন ভাবে আপনি বিচ্ছিন্ন অনুভব না করেন।
আর আমি? আমি সেই সুযোগে উনাদের কাছ থেকে খাবলিয়ে নিই জানা- অজানা কতো নতুন পুরাতন তথ্য। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু আইরিশ কমিটি/ অর্গানাইজেশন এর সাথে জড়িত যেখানে আমি ছাড়া সবাই অবসরপ্রাপ্ত , ৬৫ উর্ধ্বে। আমি গেলে উনারা মহা খুশি হোন, সাদরে আমন্ত্রণ জানান, বলেন ‘’ মাক্সুদা তুমি এলে আমরা নিজেদের ইয়াং অনুভব করি।’এই মানুষগুলোর সারাজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ। কতো কিছুই না তাদের কাছ থেকে নেয়ার আছে, শিখার আছে। আমার ক্ষুধা ঐ জায়গায়। তুচ্ছ একটা বিষয়ে ছোট্ট একটা টেকনিক শিখাইবা কম কীসের? ওদের একটা কথা প্রচলিত আছে,’’ ছোট্ট কোন কাজের টেকনিক সঠিক পন্থায় করতে না পারলে সহজেই জীবন কঠিন।’
অথচ আমাদের দেশে বয়সের ব্যবধান ছবিটা একটু চোখ বন্ধ করে , ‘’ আরে অতো ছোট মানুষ, ওর সাথে কি আর কি কথা? বা ও আর কি বুঝবে? ’’ ব্যাপারটি ভাইস-ভার্সাও ঘটে। কারণ একটাই , আমাদের ফ্রেন্ডলি আচরণের অভাব। উনাদের সময়গুলো চলে যায় সিনিয়র-জুনিয়র অংক কষতে কষতে। উনাদের জীবনের Grade যেনো নির্ভর করে ঐ লোক দেখানো ফুটানিতে। শব্দগুলো শুনতে (পড়তে) যদিও একটু তিক্ত লাগবে, কিন্তু সহজ ভাষায় ধ্রুব সত্য।
মাই গড, লেখাটা অলরেডি বেশ বড় হয়ে গেলো , আমি এবার থামি । পরিশেষে আমি বলবো, বয়স, লিঙ্গ নির্বিশেষে আপনাদের গঠনমূলক আলাপচারিতায় সবাইকে Include করুন , কেউ কম জানে, তাই বলে কেউ যেন কর্নার হয়ে না পড়ে খেয়াল রাখার চেষ্টা করুন। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, রান্নাঘর আর ড্রেসিং টেবিলের বাইরে বিশাল এক পৃথিবী দরজার ওপাশে। জানি আমাদের অনেক কাজ থাকে সংসারে, কিন্তু যখনই সুযোগ পান, দরজার ওপাশে উঁকি দিন।
পরনিন্দা, অন্যের সাথে তুলনা, অহংকার, লোক দেখানোর মিথ্যে চর্চায় নিজের কিছু অর্জন হয় না, একটা জিনিসই বাড়ে, তাহলো হতাশা ।
লেখক : আয়ারল্যান্ডপ্রবাসী পেশাদার বৈমানিক। মডেল।
এইচআর/এমকেএইচ