মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং ডিএফপির রেট কার্ড!
গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ওয়েজ বোর্ড একটি মধুর শব্দ। তবে সবার জন্য নয়। যারা প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করেন, তাদের জন্য ওয়েজ বোর্ড সত্যি মধুর। টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়া এখনও ওয়েজ বোর্ডের আওতার বাইরে। আমার ক্যারিয়ারের একটা বড় অংশ কেটেছে প্রিন্ট মিডিয়ায়, তাই ওয়েজ বোর্ডের আনন্দটা আমি জানি।
৯০ সাল খেকে টুকটাক লেখালেখি শুরু করেছি। সাপ্তাহিক বিচিন্তা, সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্ম, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক জনকণ্ঠ হয়ে ১৯৯৫ সালে আমি দৈনিক ভোরের কাগজে যোগ দেই স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে। ভোরের কাগজেই আমি প্রথম ওয়েজ বোর্ডের অধীনে বেতন পাই। তখন চতুর্থ ওয়েজবোর্ডে স্টাফ রিপোর্টারের শুরুর বেতন ছিল ৬ হাজার ১২০ টাকা। ভোরের কাগজের রিপোর্টিং টিমে আমি ছাড়াও তখন মুন্নী সাহা, জ ই মামুন, জায়েদুল আহসান পিন্টু ও পারভেজ খান স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে একই স্কেলে বেতন পেতাম।
আরো অনেকে ছিলেন সিনিয়র রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি বা শিক্ষানবিশ রিপোর্টার। ভোরের কাগজ থেকে প্রথম আলোতে গিয়েও ওয়েজ বোর্ড সুবিধা পেয়েছি। প্রথম আলো অবশ্য তখন থেকেই ওয়েজ বোর্ডের চেয়ে বাড়তি সুবিধা দিতো সাংবাদিকদের। সংবাদকর্মীদের অফিস থেকে জ্বালানিসহ গাড়ি দেয়ার অভিনব ধারাটি প্রথম চালু করেছিল প্রথম আলোই। চিফ রিপোর্টার হিসেবে সেই সুবিধার প্রথম লটে আমিও একটি গাড়ি পেয়েছিলাম।
আমার জীবনের প্রথম গাড়ি, লাল রঙের মারুতি ৮০০ সিসি। যতদিন প্রিন্ট মিডিয়ায় ছিলাম, ততদিন নতুন ওয়েজ বোর্ডের জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতাম। নতুন ওয়েজ বোর্ড আসলেই ভালো বেতন বাড়তো। তাতে বদলে যেতো জীবনযাত্রার মান। আমি চতুর্থ ওয়েজ বোর্ডে শুরু করেছি, এখন গণমাধ্যমে অষ্টম ওয়েজবোর্ড চলছে। শিগগিরই ঘোষিত হতে যাচ্ছে নবম ওয়েজবোর্ড। নতুন ওয়েজবোর্ডের প্রস্তাবনা নিয়েই এখন চলছে মালিকপক্ষ এবং সাংবাদিকপক্ষের বিতর্ক।
গত ১৩ জুন পত্রিকায় নিউজপেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াব’এর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে নবম ওয়েজ বোর্ডের সম্ভাব্য প্রস্তাবকে ‘অবাস্তব’ উল্লেখ করে এটি সংবাদপত্র শিল্পে বড় সংকট তৈরি করবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। নোয়াবের ১৩০০ শব্দের বিস্তারিত বিবৃতিতে বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্প কতটা সঙ্কটে আছে, সাংবাদিকরা কত বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন; তার বিবরণ দেয়া হয়। নোয়াবের এই বিবৃতি অসত্য এবং বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। নোয়াবের এই বিবৃতির প্রতিবাদে সাংবাদিক অনুপ খাস্তগীর বিডিনিউজে একটি লেখা লিখেছেন। সেখানে তিনি নোয়াবের দাবির অসারতা প্রমাণ করেছেন। তাই আমি আর তার পুনরুক্তি করছি না।
তবে অসত্য তথ্যের চেয়েও আমার কাছে যেটা ভয়াবহ লেগেছে, তাহলো মালিকদের মানসিকতা। তাদের সব চেষ্টা ছিল কিভাবে সাংবাদিকদের বঞ্চিত করা যায়, হেয় করা যায়। তারচেয়েও বড় কথা, মালিকরা সাংবাদিকদের অন্য পেশার সাথে তুলনা করতে গিয়ে খাটো করেছেন। একটি উদাহরণ দেই, ‘অষ্টম ওয়েজ বোর্ডে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী একজন রিপোর্টার গ্রেড-৩–এ যোগদান করেন ৩৮,০৭৩ টাকা বেতনে। যেখানে বর্তমান সরকারি বেতন স্কেলের অধীনে সেরা ছাত্ররা একজন সিভিল ক্যাডার শুরুতে গ্রেড-৯–এ যোগদান করেন ৩৫,৬০০ টাকা বেতনে।‘ লক্ষ্য করুন, সিভিল ক্যাডারের আগে ‘সেরা ছাত্র’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মানে 'সেরা ছাত্র'রা সাংবাদিকতা করে না। এভাবে এক পেশার মানুষের সাথে আরেক পেশার তুলনা করাটাই আপত্তিকর। আর আপনি যখন একটি পেশার মানুষকে সেরা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আরেকটি পেশাকে খাটো করেন, তখন সেটা আরো বেশি আপত্তিকর।
একটা উদাহরণ দেই, প্রথম আলোর আনিসুল হক বুয়েটে পড়াশোনা করেছেন। সাংবাদিকতা শুরুর কয়েকদিন পর তিনি বিসিএস দিয়ে রেলওয়েতে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস তিনি কদিন পরেই আবার সাংবাদিকতায় ফিরে এসেছিলেন। প্রথম আলোর সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রও প্রকৌশলী। যদিও সে বিদ্যা কখনো কাজে লাগাননি। খালেদ মুহিউদ্দিন বিসিএস দিয়ে কয়েকমাস ম্যাজিস্ট্রেসি করে আবার সাংবাদিকতায় ফিরে এসেছিলেন। এমন আরো অনেক উদাহরণ দেয়া সম্ভব। টাকার অঙ্কে অনেক লোভনীয় চাকরির সুযোগ ছেড়ে অনেকে সাংবাদিকতা করছেন। সাংবাদিকতা নিছক পেশা নয়, এটা নেশার মত, অন্যরকম এক ভালোবাসার নাম। আমি কোনো পেশার কাউকে খাটো করতে চাই না। পেশাটা হলো যার যার পছন্দের ব্যাপার। আমার নিয়োগকর্তা যদি মনে করেন, আমি সেরা নই, তাহলেই বিপদ।
মালিকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা যদি মনে করেনই, সাংবাদিকদের বেতন সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি এবং তারা সেরা নয়। তাহলে আপনারা বেশি বেতন দিয়ে সেরা ছাত্রদের নিয়োগ দিন। তবুও হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না প্লিজ। হীনম্মন্যতা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটা ঠিক, একসময় ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী সাংবাদিকদের বেতন তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। এটারও যুক্তি ছিল। সরকারি চাকরিতে বেতন কম হলেও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, কোয়ার্টার, পেনশন, প্রভিডেন্ড ফান্ড, সর্বোপরি চাকরির নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু সাংবাদিকতাসহ বেসরকারি চাকরিতে তা নেই। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হলো সাংবাদিকতা। কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভালো মালিকরা তবু তিন মাসের নোটিশ দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো বলে দেয়া হয়, কাল থেকে আর আসার দরকার নেই বা অফিসে গিয়ে জানতে পারে তার চাকরি নেই। পেনশন তো অনেক পরে, প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি বা বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধাও নেই বেশিরভাগ জায়গায়।
তো এই ঝুঁকির জন্যও তো তাদের বেশি বেতন প্রাপ্য। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন এখন সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি। তবে এই কম বেশির হিসাব তো ওয়েজ বোর্ডের কেতাবে, গোয়ালে কী আছে, সেটা কি মালিকরা জানেন না? বাংলাদেশে কয়টা পত্রিকা সত্যি সত্যি ওয়েজবোর্ড দেয়? সেই আলোচনায় পরে আসছি।
নোয়াবের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, ওয়েজ বোর্ড একতরফাভাবে সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। এটা ডাহা মিথ্যা। আসল সত্য হলো, নোয়াব সদস্যরা বোর্ডেকে সহায়তা করেননি, মামলা করে ঝুলিয়ে রেখেছেন, নানাভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। এখন যখন সব চেষ্টা ব্যর্থ, তখন নিজেদের মালিকানার পত্রিকায় নিজেদের বিশাল বিবৃতি ছেপে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আবারও প্রথম আলোর কথায় আসি। ১৩ জুন নোয়াবের বিবৃতি ছাপা হয়েছে প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্বের সাথে বিস্তারিতভাবে। আর রোববার সাংবাদিক ইউনিয়নের পাল্টা বিবৃতি ছাপা হয়েছে চারের পাতায় অবহেলার সাথে। মালিকরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের হাত দিয়েই তাদের জন্য অবমাননাকর বিবৃতিটি ছাপতে বাধ্য করেছেন। আপনাদের এত আপত্তি বোর্ডের কাছে বলেননি কেন? সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের দাবি নবম ওয়েজ বোর্ড যখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে, তখন এই বিবৃতির মানে কি?
নোয়াবের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকার ঘোষিত ৪২টি শিল্পের মধ্যে কোনো শিল্পেরই বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা সংবাদপত্র মজুরি বোর্ডের মতো নয়। এটা সাংবাদিকতা পেশার জন্য আরো বড় অবমাননাকর। সংবাদপত্রের মালিকরা যদি সংবাদপত্র শিল্পকে অন্য ৪২টি শিল্পের সাথে তুলনা করেন, তারচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু নেই। মানছি সংবাদপত্রও শেষ পর্যন্ত ব্যবসাই। কিন্তু অবশ্যই এটা অন্য ব্যবসার মত নয়। লাভক্ষতিই যদি একমাত্র বিবেচ্য হয়, তাহলে মালিকরা পত্রিকা বন্ধ করে কারওয়ানবাজারে আলু পটলের ব্যবসা করুন, মৌলভীবাজারে চালের আড়ত দিন বা সাভারে গার্মেন্টস কারখানা খুলুন। শুধু লাভ চাইলে পত্রিকা ব্যবসা আপনার জন্য নয়। আমরা জানি মালিকদের কাছে পত্রিকা শুধু ব্যবসা নয়, অস্ত্র। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার অনেক আগেই বলেছেন, আগে বিত্তবানরা সম্পদ পাহাড়ার জন্য কুকুর পুষতো, এখন সাংবাদিক পোষে। এটাই বাস্তবতা। মালিকরা পত্রিকাকে ব্যবহার করেন অন্য ব্যবসার ঢাল হিসেবে, সমাজে প্রতিপত্তির জন্য। অন্য সব ব্যবসার লাঠিয়াল হিসেবে পত্রিকা বের করেছেন; আবার পত্রিকা থেকেও লাভ চাইবেন; এ কেমন আবদার।
সংবাদপত্রের মালিকরা সরকারের কাছ থেকে নানান সুবিধা নেন। প্লট নেন, ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। বাজেটের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা যেন তাদের মালিকদের কাছে জানতে চান, তারা কত টাকা ঋণ নিয়ে কয় টাকা শোধ করেছেন। নোয়াব কি আমাদের এই হিসাবটা জানাতে পারে? যদি শেখ হাসিনা অসত্য অভিযোগ করে থাকেন, সেটাও বলুন।
নোয়াবের বিবৃতিতে সংবাদপত্র শিল্পের নানা সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞাপন সঙ্কট, তীব্র প্রতিযোগিতা, উৎপাদন খরচের এক-তৃতীয়াংশ দামে বিক্রি করা ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকগুলোর সাথেই আমি একমত। আমিও চাই সরকার সংবাদপত্র শিল্পের সুরক্ষায় আরো সহায়তা দিক। মালিকরা বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানোর দাবি করুক, আমরাও তাদের পাশে থাকবো। কিন্তু সাংবাদিকদের বেতন বাড়ানোর পথে বাধা হবেন কেন? কেন হেয় করে সাংবাদিকদের মুখোমুখি নিয়ে গেলেন নিজেদের?
মালিকরা পত্রিকা প্রকাশ করছেন বলেই আমরা সেখানে চাকরি করছি। তারা আমাদের অন্নদাতা। তাদের সঙ্কটে অবশ্যই আমরা তাদের পাশে থাকবো। কিন্তু তারা যদি মনে করেন, তারা যাদের চাকরি দিচ্ছেন, তারা সেরা ছাত্র নয়; যদি মনে করেন, তারা আমাদের করুণা করছেন; তাহলে ভুল করবেন। আমরা আমাদের মেধা, শ্রম দিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের পত্রিকাটা বের করি। সাংবাদিকদের চাকরির কোনো সময়সীমা নেই। আমাদের যদি আপনাদের পছন্দ না হয়, তাহলে আমাদের নিয়ম মেনে আমাদের বাদ দিয়ে বেশি পয়সায় 'সেরা ছাত্র'দের নিন। তবুও আমাদের বেতন বাড়ার পথে বাধা হবেন না, আমাদের পেটে লাথি মারবেন না।
নোয়াবের বিবৃতির শেষ দিক থেকে আরেকটু উদ্ধৃত করছি, 'সর্বশেষ (০৩/০৬/২০১৯) চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের নিরীক্ষা শাখার প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে মোট ৬৮৪ (ঢাকা ৩৪৬ + মফস্বল ৩৩৮)টি পত্রিকার মধ্যে ১৫৮ (ঢাকা ১০৯ + মফস্বল ৪৯)টি (প্রায় ২৩%) পত্রিকা অষ্টম মজুরি বোর্ড বাস্তবায়ন করেছে। যদিও এই প্রতিবেদনের সঙ্গেও বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যায় না। নোয়াবের জানামতে, অল্প কিছু সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানই কেবল পুরোপুরি মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ বাস্তবায়ন করে।' ডিএফপির ওয়েবসাইটে গিয়ে পুরো প্রতিবেদনটি দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দশা। এতদিন জানতাম মিথ্যা তিন প্রকার- মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা, পরিসংখ্যান। এখন থেকে মিথ্যার সংজ্ঞাই বদলে দিলাম। মিথ্যা তিন প্রকারই- মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও ডিএফপি রেট কার্ড। এই রেট কার্ড সংবাদপত্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার সংবাদপত্র বিজ্ঞাপন দেয়। তবে বিজ্ঞাপনের রেট নির্ভর করে পত্রিকার সার্কুলেশনের ওপর, ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করার ওপর। তাই পত্রিকাগুলো বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য এবং ভালো রেট পাওয়ার জন্য সার্কুলেশন বাড়িয়ে দেখায়, ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। বাস্তবতার সাথে যার কোনো মিল নেই।
নোয়াবের বিবৃতিতেও এটাই বলা হয়েছে। তাহলে কারা বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য সার্কুলেশন বাড়িয়ে দেখাচ্ছে, কারা ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের মিথ্যা দাবি করছে; তাদের মুখোশ উন্মোচন করুন। পত্রিকা দাবি করলেই তো আর সেটা ডিএফপি মেনে নেবে না। এর জন্য নানা কমিটি আছে। পরিদর্শন আছে, প্রতিবেদন আছে। বুঝতে পারছেন তো। সব নাকি ঠিক হয় টাকায়। পত্রিকাওয়ালারা মানুষকে সত্য কথা জানানোর দাবি করেন। আর নিজেদের সার্কুলেশনের ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য দেন। পত্রিকাগুলো সবার দুর্নীতির কথা লেখেন, ডিএফপির ব্যাপারে চুপ থাকেন। অথচ ডিএফপি হলো দুর্নীতির আখড়া। আপনার পত্রিকা যদি ২০০ কপি ছাপা হয় এবং ডিএফপির সংশ্লিষ্ট টেবিলে পৌঁছে দেন, সাথে যদি মোটা খাম থাকে, ডিএফপির তালিকায় আপনার সার্কুলেশন হবে ২ লাখ টাকা, বিজ্ঞাপন পাবেন উচ্চ রেটে। এ এক ভয়াবহ চিত্র। শুনি সাংবাদিক নেতারাও এই রেট কার্ড বাণিজ্যের সাথে জড়িত। কারণ সার্কুলেশন ও ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নানা কমিটিতে সাংবাদিক নেতারা থাকেন। কোনোদিন কাউকে ডিএফপির এই তালিকা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুনিনি।
পত্রিকার ব্যবসাটা খুব সহজ। ডিসি অফিস থেকে একটা ডিক্লারেশন নেবেন। কয়েকদিন ধৈর্য্য ধরে ডিএফপির তালিকাভুক্ত করাবেন। তারপর নানা জায়গায় ঘুষ দিয়ে রেট কার্ডটি ঠিক করে নেবেন। ব্যস, তারপর আরাম আর আরাম। ফকিরাপুলে একটি এক রুমের অফিস নেবেন। দুইটা ছেলে রাখবেন। তারা নানা অনলাইন থেকে কাট পেস্ট করে পত্রিকা বানিয়ে দেবে। আপনি গোটা পঞ্চাশেক কপি ছেপে সেগুলো নিয়ে ডিএফপিতে যাবেন, সচিবালয়ে যাবেন, প্রেসক্লাবে যাবেন। আপনি সরকার স্বীকৃত পত্রিকার সম্পাদক। সমাজে আপনার ভাবই আলাদা থাকবে। সব দিয়ে থুয়েও মাসে আপনার কয়েক লাখ টাকা থাকবে, সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে। ফকিরাপুলে একই রুম থেকে ম্যাটার ওপর নিচ করে আর মাস্ট হেড বদলে একাধিক পত্রিকা বেরুচ্ছে, এমন দৃশ্য আমি নিজে দেখেছি একসময়। নোয়াব সাংবাদিকদের পেছনে না লেগে যদি এই রেট কার্ড বাণিজ্যের পেছনে লাগতেন, তাহলে তাদের সমস্যা অনেক মিটে যেতো।
মাননীয় তথ্যমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী রেট কার্ড নিয়ে বসুন। এটা যে মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা; সেটা নিশ্চিত করতে মাসুদ রানা হতে হবে না; মাসুদ রানার সহকারী গিলটি মিয়াও বুঝবে। আপনারা কার্ডটি নিয়ে খোঁজ লাগান, কারা কারা এই মহা মিথ্যার সাথে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করুন। পত্রিকার মালিক ডিএফপির কাকে ঘুষ দিয়েছে, কোন সাংবাদিক নেতাকে হাত করেছে; তাদের চিহ্নিত করুন। আপনার পত্রিকা বন্ধ করার দরকার নেই। খালি মিথ্যা তথ্য দেয়ার দায়ে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিন। দেখুন তেলেসমাতি। এটা করতে পারলে মূলধারার পত্রিকাগুলো লাভবান হবে। তাদের বিজ্ঞাপন বাড়বে। এবার বাজেট ঠিক রেখে মূলধারার পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের রেট অনেক বাড়িয়ে দিন, যাতে তারা সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন দিতে পারে। ই-টেন্ডারিঙের নামে সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে আনার প্রবণতা বন্ধ করুন। বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমলেও, রেট বাড়িয়ে সেটা পুষিয়ে দির। সংবাদপত্র শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু তার মানে এই নয়, ফকিরাপুলের আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি বিজ্ঞাপন দিতে হবে। পত্রিকার সংখ্যা নয়, মান নিশ্চিত করুন। নোয়াবের দাবি যদি সত্যি হয়, সংবাদপত্র শিল্প যদি গভীর সঙ্কটে থাকে, তাহলে সারাদেশ থেকে মোট ৬৮৪টি পত্রিকা কেন প্রকাশিত হচ্ছে?
ডিএফপির ওয়েবসাইটে গেলে আপনারা যে কেউ তালিকাটি দেখতে পাবেন। আলসে লোকজনের জন্য এই লেখার সাথে ঢাকা থেকে প্রকাশিত শীর্ষ ৫০টি দৈনিকের তালিকা দিলাম। এই ৫০টির মধ্যে অন্তত ৩০টির নামই আমি শুনিনি। অনেকগুলোর নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি। আপনি চোখ বন্ধ করে তালিকায় আঙ্গুল রাখুন, যেটাতে রাখবেন, সেটাই মিথ্যা। ডিএফপি যেন এক মায়ার জগত। আচ্ছা ধরুন ডিএফপির তালিকা অনুযায়ী মুক্তখবর নাম একটি পত্রিকার সার্কুলেশন ৮০ হাজার। আপনি কি বিশ্বাস করেন, আমি করিনা। সন্দেহ হলে কাল সকালে কোনো পত্রিকার স্টল থেকে এই পত্রিকার একটি কপি সংগ্রহ করুন। পারলে আমাকেও এক কপি দেবেন। মুক্তখবর পত্রিকা সংশ্লিষ্ট কেউ ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। নাম যে কোনোটিরই নেয়া যেতো। পত্রিকার ছাপা আর সার্কুলেশন কিন্তু এক নয়। ডিএফপির দাবি সত্যি হলে, বাংলাদেশে অন্তত ৮০ হাজার বোকা লোক আছে, যারা প্রতিদিন পকেটের পয়সা দিয়ে প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ, সমকাল, যুগান্তর না কিনে মুক্তখবর কেনেন।
ডিএফপির তালিকা অনুযায়ী ঢাকার ৮৫টি বাংলা, ২৪টি ইংরেজি ও মফস্বলের ৪৯টি; মানে মোট ১৫৮টি পত্রিকায় ৮ম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করেছে। আপনি এটা বিশ্বাস করেন? আমি কিন্তু করি না। আমার ধারণা ১৫৮ নয়, বড় জোর ১৫টি পত্রিকায় ৮ম ওয়েজবোর্ড পুরো বাস্তবায়ন করে। ডিএফপির দাবি সত্যি হলে, মানে ১৫৮টি পত্রিকায় ৮ম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়িত হলে, কথা দিচ্ছি আমি আর কোনোদিন নবম ওয়েজবোর্ডের দাবি তুলবো না।
নোয়াবের সদস্যদের বিনীতভাবে বলছি, সাংবাদিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেদের বিবৃতি না ছাপিয়ে, ডিএফপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। মালিক, সাংবাদিক সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে রেট কার্ড বাণিজ্যের বিরুদ্ধে, দুনীতির বিরুদ্ধে, মিথ্যা সার্কুলেশন আর ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের মিথ্যা দাবির বিরুদ্ধে আন্দোলন করুন। ই-টেন্ডারিঙের নামে বিজ্ঞাপন কমানোর প্রতিবাদ করুন, বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানোর দাবি করুন, কমিশন ছাড়াই বিজ্ঞাপন ও বিল পাওয়ার নিশ্চয়তা দাবি করুন। আমরা পাশে থাকবো। মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে কখনো সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজকে আলোকিত করতে হলে আগে ঘরের অন্ধকার দূর করুন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত শীর্ষ ৫০ দৈনিকের তালিকা দিচ্ছি। মিলিয়ে দেখুন তো আপনি কয়টির নাম শুনেছেন, কয়টি দেখেছেন, কয়টি পড়েছেন?
বাংলাদেশ প্রতিদিন (৫ লাখ ৫৩ হাজার ৩০০), প্রথম আলো (৫ লাখ ১ হাজার ৮০০), কালের কণ্ঠ (২ লাখ ৯০ হাজার ২০০), যুগান্তর (২ লাখ ৯০ হাজার ২০০), ইত্তেফাক (২ লাখ ৯০ হাজার ২০০), আমাদের সময় (২ লাখ ৯০ হাজার ২০০), জনকণ্ঠ (২ লাখ ৯০ হাজার ২০০), সমকাল (২ লাখ ৭১ হাজার), ভোরের কাগজ (১ লাখ ৬১ হাজার ১৬০), আমাদের নতুন সময় (১ লাখ ৬১ হাজার ১৫৫), মানবকণ্ঠ (১ লাখ ৬১ ১৫০), প্রতিদিনের সংবাদ (১ লাখ ৬১ হাজার ১৪০), সংবাদ (১ লাখ ৬১ হাজার ১২০), ইনকিলাব (১ লাখ ৬১ হাজার ১১০), আমার সংবাদ (১ লাখ ৬১ হাজার ১০৫), মানবজমিন (১ লাখ ৬১ হাজার ১০০), আলোকিত বাংলাদেশ (১ লাখ ৫২ হাজার), আমাদের অর্থনীতি (১ লাখ ৫১ হাজার ৫০০), ভোরের ডাক (১ লাখ ৫১ হাজার ৩০০), ভোরের পাতা (১ লাখ ৫১ হাজার ২১০), আজকের বিজনেস বাংলাদেশ (১ লাখ ৪২ হাজার), বণিক বার্তা (১ লাখ ৪১ হাজার ৫০০), বাংলাদেশের খবর (১ লাখ ৪১ হাজার ২৫০), জনতা (১ লাখ ৪১ হাজার ১১০), খোলাকাগজ (১ লাখ ৪১ হাজার ১০০), ঢাকা প্রতিদিন (১ লাখ ৪১ হাজার ৫০), গণকণ্ঠ (১ লাখ ৪১ হাজার), নবচেতনা (১ লাখ ৪১ হাজার), সংবাদ প্রতিদিন (১ লাখ ২৬ হাজার ১০০), আজকালের খবর (১ লাখ ২৫ হাজার), সকালের সময় (১ লাখ ২২ হাজার), আমার বার্তা (১ লাখ ২১ হাজার), বর্তমান (১ লাখ ১৮ হাজার), যায়যায়দিন (১ লাখ ১৬ হাজার), হাজারিকা প্রতিদিন (১ লাখ ১০), লাখোকণ্ঠ (১ লাখ), নয়াদিগন্ত (৯০ হাজার ৬৫০), ভোরের দর্পণ (৯০ হাজার ১০০), বাংলাদেশ কণ্ঠ (৯০ হাজার), খবর (৮৯ হাজার ৫০০), আমার সময় (৮২ হাজার), মুক্তখবর (৮০ হাজার), স্বাধীন বাংলা (৮০ হাজার), কালবেলা (৮০ হাজার), সোনালী খবর (৭৬ হাজার), শেয়ার বিজ কড়চা (৭৬ হাজার), দৈনিক বাংলা (৭৫ হাজার), বাংলাদেশ সমাচার (৭১ হাজার), আজকের দর্পণ (৬৪ হাজার), সমাজ সংবাদ (৬২ হাজার)।
১৬ জুন, ২০১৯
এইচআর/পিআর