ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিএনপির জন্য কিছু কথা

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ০২:৫৪ পিএম, ২৩ মে ২০১৯

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংসদে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এমপিদের নিয়ে একটি সংসদীয় গ্রুপের নেতৃত্ব দিবেন এবং জাতীয় পার্টিকে ছাপিয়ে জনগণের কাছে তারাই সত্যিকারের বিরোধীদল প্রমাণ করবেন- এটা আমার ধারণা ছিল, প্রত্যাশাও ছিল। সংসদে তারা গেলেন সত্য কিন্তু নিজেদের আগে-পরের সিদ্ধান্তকে দল-জোট-জনগণ সবার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সর্বোপরি সবাই গেলেন কিন্তু মির্জা ফখরুল গেলেন না। বিএনপি মহাসচিব নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য ৩০ ডিসেম্বরের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সংসদ এড়াতে শপথ নিলেন না, নাকি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কূটরাজনীতির বলী হলেন তা এখনও পরিষ্কার হয়নি।

মির্জা ফখরুল বলেছেন যে তাদের বিজয়ী এমপিদের শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলো। এখন শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক হয়েছে। অবশ্য, সে সঠিক সিদ্ধান্তটা তিনি নিজে অনুসরণ করেননি বলেই নানা কথা হচ্ছে। আসলে নির্বাচিত এমপিদের শপথ থেকে বিরত রাখার উদ্যোগই ছিলো ভুল। বিএনপির হিতৈষী এবং গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। জটিল ও কঠিন এক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে পদত্যাগ করবেন- এমন এক নাজুক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ভুল ছিল। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে সে সিদ্ধান্তটা মেনে নির্বাচিত এমপিরা শপথ গ্রহণ না করলেও দল কোনভাবে উপকৃত হতো না।

যাক, শেষ পর্যন্ত শপথের ব্যাপারে দল অনুমতি দিয়েই ভাল করেছে। নিস্ফলা বিষয়ে দলের অভ্যন্তরে বিরোধ লাগানো ভাল নয়। এমপিদের সঙ্গে বিরোধ করা থেকে দল অব্যাহতি পেয়েছে। যদিও শপথ নেওয়া নিয়ে ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ধরেছে। আন্দালিব রহমান পার্থ জোট ছেড়ে গেছেন।

বিশ দলীয় জোটের শরীকরা ছোট ছোট সংগঠন হলেও দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিএনপির সঙ্গে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করার চেষ্টা করেছে। সুতরাং তাদেরও একটা সহযোগিতামূলক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। সম্ভবতো তা উপলব্ধি করেই সম্প্রতি বিএনপি তাদের নিয়ে বৈঠক করেছে। এলডিপির কর্নেল (অঃ) অলি আহম্মদ বলেছেন, বিএনপি হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিক আর না হয় নেতৃত্বের জায়গাটা ছেড়ে দিক।

অবশ্য নেতৃত্বের বাড়াবাড়ি তো বিএনপিকে সৃষ্টি করতে আমরা দেখিনি। ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রবকে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে বিএনপি তো বৃহত্তম ঐক্য গড়ে ছিল। তাতেও তো কোনও লাভ তারা ঘরে আনতে পারেনি। বিএনপি বলবে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যা হয়েছে জনগণ দেখেছে। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনে, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। মেনে নিলাম তাদের এই অভিযোগ সত্য। কিন্তু জনগণ কি এই নির্বাচনের বিরোধিতা করে, প্রতিবাদ করে পথে নেমেছে? নামেনি এবং নামার প্রয়োজনও মনে করে না।

বিএনপি ভোটের অংকে জনপ্রিয় হলেও তার যে জনসম্পৃক্ততা নেই- বিএনপি এটা উপলব্ধি করার প্রয়োজনই মনে করে না। বিএনপির আজকের পরিণতি তাদের অতীত রাজনীতির ইজাটানা ফলাফলের কারণেই। ২১ শে আগস্টে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে বিএনপি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ সব নেতৃত্বকে হত্যা করে তাদেরকে আবারও ২১ বছর পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন কর্মী ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছিলো। বহু নেতার গায়ে এখনও প্লিন্টার বিধে আছে। মেয়র হানিফের গায়ে প্লিন্টার নিয়েই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ বিএনপির এমন কাজটিকে কখনও মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা ক্ষমতায় এসে বিএনপির মাঠের রাজনীতিকে কঠিন করে তুলেছে। বিএনপি খন্দকার মোশতাক আহমেদের ডেমোক্রেটিক লীগের জনসভায়ও গ্রেনেড মেরে মেরে লোক হত্যা করে তাদেরকে মাঠ থেকে তুলে দিয়েছিলো। বিরোধীদের হত্যা করে নিঃশেষ করার এ সংস্কৃতিটা চালু করেছিলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। সে অমানবীয় পদ্ধতিতে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার চেষ্টা হয়েছে। তারেক জিয়া তার পৈতৃক পদ্ধতিটা এখানে প্রয়োগ করেছেন। ভাগ্যের ফেরে শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন।

রাজনীতি কোনও যুদ্ধ নয় যে প্রতিপক্ষকে হত্যা করে বিজয় ছিনিয়ে নিতে হবে। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে হয়। জিয়াউর রহমান এই সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে চাইতেন না। তারেক জিয়াও বাবার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে নিজের জন্য, দলের জন্য দীর্ঘস্থায়ী এক দুর্যোগ ডেকে এনেছেন। আওয়ামী লীগ যখন কঠিন রাজনৈতিক পদক্ষেপ দিয়ে বিএনপিকে প্রতিরোধ করছে তখন তাকে মোকাবেলা করা বিএনপির পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ বিএনপির জনসভা কোনও গ্রেনেড হামলা করেনি।

যা হোক, আমরা চাই যে বিএনপি এখন একটা শাসনতান্ত্রিক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করুক। কথায় কথায় বিরোধিতা না করে মঙ্গলজনক কাজের প্রশংসা করুক আর অমঙ্গলজনক কাজের বিরোধিতা করুক। শুধু দলের কথা না বলে জনগণের কথা বলুক। এরশাদের পতনের পর যে ধারায় রাজনীতি প্রবাহিত হয়েছিলো আমরা মনে করেছিলাম আমাদের দেশেও দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি। কোনও ভাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সরকারি দল বিরোধী দল সবাইকে সহনশীল হতে হয়। প্রয়োজনে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। আমরা তো কিছুই করি না।

আগামী ২৪ শে জুন বগুড়ার উপ-নির্বাচন হবে। মিডিয়ায় দেখলাম বিএনপি নাকি মাহামুদুর রহমান মান্নাকে নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে চাচ্ছে। বিএনপির লোকের অভাব নেই, তারা তাদের লোক না দিয়ে অন্য দলের লোক দিতে চাচ্ছে কেন বুঝে আসছে না। প্রয়োজনে তাদের মহাসচিব পুনরায় উপ-নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সংসদে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন লোক পাঠানো উচিৎ সে বিবেচনায় ব্যারিস্টার মওদুদকে বেছে নেয়াও উত্তম হবে। তিনি একজন ভাল ও বিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান। নয়তো বিএনপির স্থানীয় একজন সদস্যকে মনোনয়নের জন্য বেছে নিতে পারেন। মান্নাকে সরকারি দল ভাল চোখে দেখে না বলেই তাদের সব শক্তি নিয়োগ করবে তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার জন্য। জেলবন্দী দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকেও প্রার্থী করার চেষ্টা রয়েছে। যদিও তা কতটুকু সম্ভব প্রশ্নবিদ্ধ।

সদ্য শপথ নেয়া এমপিদের মধ্যে হারুন-অর-রশিদ সংসদে খুবই সুন্দর বক্তব্য পেশ করেছেন। উস্কানিমূলক কোনও কথা ছিলো না তাতে। অথচ প্রয়োজনীয় কোনও কথাও বাদ যায়নি। বিএনপি তার সংরক্ষিত মহিলা আসনের জন্য একজন লেখাপড়া জানা নেত্রীকে পছন্দ করেছে। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। একাধিক প্রার্থী না থাকায় তার বিজয়ী হওয়া এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিএনপি এখানে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। অতীতের মতো সংসদে গিয়ে গালাগালি, হঠকারি কথাবার্তা বলার কাউকে এবার মনোনয়ন দেয়নি।

বিএনপি কাকে মনোনয়ন দিবে, কাকে পার্লামেন্টে আনবে এসব বিষয়ে আমাদের কথা না বলাই উত্তম ছিলো তবুও বলছি এই কারণে যে, কোনও অতি কথনের দুষ্টু লোক সংসদে প্রবেশ না করে। একবার নাজমুল হুদার এক কথায় আওয়ামী লীগ যে সংসদ বর্জন করেছিলো তারা আর ফিরে আসেনি। শেষ পর্যন্ত সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করেছিলো। বিএনপির সংসদ সদস্য সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন’কে কটাক্ষ করাসহ প্রায়শ সংসদে বাজে কথা বলতেন। সংসদ বাজে কথা বলার জায়গা নয়। কিন্তু কিছু হঠকারী লোক তা বলতো। তাতে সম্প্রীতি নষ্ট হয়।

বিএনপি এতো ঝামেলায় আছে যে তার অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। আর নতুন কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করা তার উচিৎ হবে না। অনেকে বলছেন, জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী তো অহরহ বলছেন, বিএনপি নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে। এখন নতুন কাউন্সিল করে নতুন নেতৃত্বের অভিষেক হওয়া উচিৎ। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাবমূর্তির সংকটে আছে। গত নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্য ভাবমূর্তি সংকটকে আরও গভীর করেছে। এখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে কিছু রদবদল জরুরি। দলের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত তরুণদের আরও সম্পৃক্ত করা দরকার। সর্বোপরি দলকে সুসংগঠিত করা জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন