ভেজালকারীদের ছাড় নয়
কবি সুকান্ত সেই কবে বলে গিয়েছেন, ‘ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়, ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়! ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা কৌন ছেড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হ্যায় ফয়দা।...কলিতে ভাই ভেজাল সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই, ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই’।
নির্ভেজাল আনন্দের জন্য ছড়ায় ভেজাল দিলে ক্ষতি না-ই থাকতে পারে। কিন্তু কবি যে সেই সত্তর বছর আগে খাবারে ভেজালের কথা লিখে গিয়েছিলেন সেই ভেজাল থেকে আদৌ আমরা মুক্তি পাইনি বরং আরো বেড়েছে। তাহলে কি এটা ‘ঘোর কলির’ দোষ নাকি কবি যে ফায়দার কথা বলেছেন সেটাই মূল কারণ। বেশ অবাক হতে হয় যখন আমরা রমজান মাসকে পবিত্র বলি কিন্তু এই মাস এলেই যেন অপবিত্র কাজ করে মাসটির মহিমা ক্ষুণ্ণ করতে উঠেপড়ে লাগি।
নিজের অভিজ্ঞতা, আত্মীয় পরিজন বা সংবাদ মাধ্যমের কারণে যেটুকু জানি উৎসব বা ধর্মীয়ভাবে পবিত্র মাসগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাবার যতোটা সম্ভব আকর্ষণীয় ও মান অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। বিপণী বিতান থেকে শুরু করে সব জায়গায় একটা ক্রেতাদের তুষ্টির ব্যাপার নিয়ে আসা হয়। সব জায়গায় চলে ছাড়ের মহোৎসব। আর আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো।
সুকান্তের সেই ছড়ার মতো কীভাবে বেশি লাভ করা যায়, কীভাবে অন্যকে ঠকিয়ে বড় হওয়া যায় সেই চিন্তায় যেন পেয়ে বসে। অনেক ব্যবসায়ীকে বলতে শুনেছি, সারা বছরের ব্যবসা নাকি এই একমাসে করতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হলো খাবারে ভেজাল দেয়া। সেটি যেমন ভীষণরকম বেড়ে গেছে এবং একটি সমাজকে ধ্বংস করে দিতে কতোটা যে ঘুণপোকার মতো কাজ করছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
চলতি বছর জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবসের স্লোগান ছিল, ‘সুস্থ-সবল জাতি চাই, পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই’। একটি জাতিকে সুস্থ দেখতে হলে নিরাপদ খাদ্যের যে কোনো বিকল্প নেই সেটি বোধহয় কারো না বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু বুঝে যে আমরা না বোঝার ভান করছি সেটি বেশি করে চোখে পড়ে রমজান মাস এলে। কারণ এই সময়ে এসে বেশি করে ভেজাল বিরোধী অভিযানে নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই সময়ে শুরু হয় বাজার মনিটরিং। সে কারণে বেরিয়ে আসে বিশ্বের বিখ্যাত সব ব্যান্ডের প্যাকেটজাত খাবার আমাদের দেশে পাওয়া যায়, বিখ্যাত সব ব্যান্ডের প্রসাধনী আমাদের দেশে তৈরি হয়।
কিন্তু আদৌতে সব দু’নম্বরি মাল। সব ভেজাল। গেলো দু’সপ্তাহের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। রাজধানীর কামরাঙ্গীচরে চারপাঁচদিনের পুরনো সিরায় বারবার তৈরি হচ্ছে মিষ্টি। ভাসছে তেলাপোকা। পোড়া মোবিলে চুবিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি সেমাই বিক্রি হচ্ছে দেশি বিদেশি ব্র্যান্ডের মোড়কে পুরে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, মাছি তেলাপোকাতো রয়েছেই। রয়েছে খাবারে ক্ষতিকারক রঙ মেশানোও। ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায় প্রতিদিনই এমন ভেজালের বিষয়টি তুলে আনছেন। রমজান মাস শুরুর আগে খোলা বাজার থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা ক্রয় করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট বা বিএসটিআই। এরপর সেসব পণ্য বিএসটিআই-এর ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এর মধ্যে ৫২টি পণ্য ল্যাব পরীক্ষায় মানোত্তীর্ণ হতে পারেনি। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সরিষার তেল, চিপস, খাবার পানি, নুডলস, হলুদ ও মরিচের গুঁড়ো, আয়োডিন যুক্ত লবণ, লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, বিস্কুট ও ঘি।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে এই পণ্যগুলো যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে তা রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কারণ সাধারণ মানুষ দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ওপর অন্তত ভরসা রাখতে চেষ্টা করে। চলতি বছর সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি একটি গবেষণা চালায়। সেই গবেষণায় গরুর দুধ এবং দই এর মধ্যে বিপদজনক অণুজীব, এন্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও সিসা পাওয়া যায়।
জাতি হিসেবে আমরা কতোটা খারাপ হলে খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে হত্যা করতে পারি। বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ার কারণে এবং দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোর কারণে এখন অনেকে চিকিৎসা নিতে পাশের দেশসহ বিভিন্ন দেশে যান। সেখান থেকে ফেরত অনেককে বলতে শুনেছি, সেসব দেশের ডাক্তাররা নাকি বলে থাকেন বাংলাদেশে খাবারের ভেজালের কারণে বেশিরভাগ রোগ হয়ে থাকে। এটি এখন সবাই জানে। সাধারণ মানুষ জানে, প্রশাসন জানে, রাষ্ট্র জানে, সরকারপ্রধান জানেন, রাষ্ট্রপ্রধান জানেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদ খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘খাদ্য পরীক্ষার জন্য একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। দেশে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার হবে। আর দেশের সব বিভাগীয় শহরে এর শাখা থাকবে। খাদ্য ক্ষতিকর বা তাতে ভেজাল আছে কি না, যে কোনো সময় যে কোনো জায়গা থেকে তা পরীক্ষা করার জন্য এই পরীক্ষাগার করা হবে।’ এটি নিঃসন্দেহে হয়তো একটি ভালো উদ্যোগ হবে। কিন্তু বছরের পর বছর খাদ্যে ভেজাল চলে এলেও এই বিষয়টি নিয়ে কেনো আমরা কখনোই খুব একটা কঠোর হই না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিভিন্ন সময়ে সরকারি নানা সংস্থা বা ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করলেও পরিস্থিতি খুব একটা উন্নতি হয়নি। এই যেমন বিএসটিআই যেসব পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেসব পণ্য নিয়েও চলছে লুকোচুরি খেলা। কোম্পানিগুলো এসব পণ্য সরিয়ে নিতে গড়িমসি করছে। আবার দেখা যায়, রমজান মাস এলে অভিযান যতোটা জোরালো হয় অন্য সময়গুলোতে ততোটা জোরালো নয়। এবং এমনও হয়তো হবে রমজানের শেষের দিকে কেউ আর অভিযান নিয়ে আগ্রহ দেখাবেই না।
আবার দেখা যায়, রাজধানী বা বড় শহরগুলোতে অভিযান যতোটা জোরালো উপজেলা পর্যায় বা মফস্বলে কোনো অভিযানই চলে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর অভিযানের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রচারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখে। কিছু কিছু অভিযান অবশ্যই মানুষকে সচেতন করে কিন্তু ঢালাওভাবে ‘শো অফ’ না করাই ভালো।
খাদ্যে ভেজাল দেয়ার দুঃসাহস দেখে হতবাক হয়েছেন খোদ উচ্চ আদালতও। প্রশ্ন তুলেছেন, ভেজালকারীরা এই সাহস কোথা থেকে পায়। আবার রাষ্ট্রকে বলেছেন, মাদকের মতো ভেজালের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে। যে বিষয়টি আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন সেটি সাধারণ মানুষের মনের কথাও। সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণেই দুষ্টচক্র বা অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্যে ভেজালকারীদের আইনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির এ দেশে নেই। অথচ উন্নত বিশ্বে বা পাশের দেশগুলোতে কঠোর শাস্তি দেয়া হয় খাদ্যে ভেজাল মেশালে।
ইসলামী দেশগুলোতে এই শাস্তি আরো ভয়াবহ। ওই সব দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর হার কমিয়ে আনা হয়েছে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে। যেটি আমাদের দেশে বেশ জরুরি। কারণ ভেজাল খাবার খেয়ে কতো মানুষ যে কঠিন রোগের শিকার হয়ে নিঃস্ব হতে বসেছে তার পরিসংখ্যান নেই। অনেক সময় পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ অসহায়। জনগণের সচেতনতাও জরুরি। কিন্তু উদ্যোগে নিতে হবে সরকারকে। কারণ অনেককে বলতে শুনেছি, কী খাবো, কোথায় খাবো। সব জায়গায় সব কিছুতেই যে ভেজাল। এখন ভালো খেলেই বরং অসুস্থ হয়ে যাবো। এটিতো মনের কথা নয়। ক্ষোভের কথা। এই দেশে জন্মটায় কি তবে আজন্ম পাপ! কিন্তু দেশটাকে যে সবাই ভালোবাসতে চায়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ।
এইচআর/জেআইএম