মধ্যপ্রাচ্যে ইরান মার্কিন রণপাঁয়তারা
পারস্য আর রোম দু’টি প্রাচীনকালের পরাশক্তি। এখন একটি ইটালি আর অন্যটি ইরান নামে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ইরান এখন মুসলিম রাষ্ট্র। পারস্য সাম্রাজ্য আর রোম সাম্রাজ্যের অবসান হয়েছিলো আসলে মুসলমানদের আবির্ভাবের পর। তখনই জরইস্ত্রিয়ানিজিম বা অগ্নি উপাসক ধর্ম থেকে ইরানিরা ধর্মান্তিরত হয়ে মুসলমান হয়েছিলো। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মাঝে ইরানও একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র। তেল, গ্যাস, ইস্পাত তাদের মুখ্য সম্পদ।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর আমেরিকার সঙ্গে ইরানের বৈরিতা অব্যাহতভাবে চলছে। পঞ্চাশ দশকে রেজা শাহ পাহলভীকে ক্ষমতা চ্যুত করে ইরানের জাতীয় নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ক্ষমতায় এসেছিলো কিন্তু আমেরিকার ষড়যন্ত্রে মোসাদ্দেক বেশিদিন টিকতে পারেননি। পুনরায় রেজা শাহ পাহলভী ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ক্ষমতাচ্যুতির পর রেজা শাহ আর ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেননি। নির্বাসনে মিশরে তার মৃত্যু হয়েছিলো।
ইরানের বিপ্লবী সরকার তেহরান দূতাবাসে আমেরিকার ৫৩ জন কর্মীকে জিম্মি করে আমেরিকার ব্যাংকে রেজা শাহ পাহলভীর গচ্ছিত অর্থ ফেরৎ এনেছিলো। জিম্মি উদ্ধারের জন্য প্রেসিডেন্ট কার্টার মিশরের সহযোগিতা নিয়ে একটা জটিকা অভিযানের আয়োজন করেছিলেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো অভিযান চালিয়ে তেহরান থেকে জিম্মি তুলে নিয়ে চলে আসা। এ অভিযান সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ ধারণা কারো না থাকলেও কানাঘুষায় একটা কথা রটেছিলো যে আমেরিকা অভিযান চালিয়ে জিম্মি উদ্ধারের চেষ্টা করছে। তখন আয়াতোল্লাহ খোমেনিকে ইটালির এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি জিম্মি উদ্ধারের অভিযান আমেরিকা চালায় তবে আপনারা প্রতিহত করবেন কিভাবে?
খোমেনি বলেছিলেন, তারা যদি এমন কোনও অভিযান চালায় তবে আল্লাহ্ তাদেরকে তেহেরানের ভূমি স্পর্শ করতে দেবেন না। আকাশেই তাদেরকে ধ্বংস করবেন। এর কয়দিন পরেই আমেরিকা অভিযান চালিয়েছিলো আর ইরানের আকাশেই পরস্পরের সংঘাতে অভিযানে অংশগ্রহণ করা প্লেন ও হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। এরপর আমেরিকা আর কোনও বাড়াবাড়িতে জড়িত হয়নি। আলজেরিয়ার মধ্যস্থতায় আমেরিকার ব্যাংকে রেজা শাহের গচ্ছিত অর্থ ফেরৎ দিয়ে জিম্মি মুক্ত করে নিয়েছিলো।
এ অপমানের প্রতিশোধ আমেরিকা কখনও প্রত্যক্ষভাবে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। অবশ্য ইরাকের সাদ্দাম যখন ইরান আক্রমণ করে তখন আমেরিকা ইরাককে অকাতরে সমরাস্ত্র সরবরাহ করেছিলো। তবে দীর্ঘ ৮ বছর যুদ্ধ চললেও ইরাক ইরানের সূচাগ্র মেদিনীও নিতে পারেনি। সবাই মনে করেছিলো খোমেনি যেহেতু শাহের সময়ের সামরিক বাহিনী ভেঙ্গে দিয়েছিলো সেহেতু যুদ্ধে ইরান কখনও ঠিকতে পারবে না। সবার ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছিলো রেভুলেশনারি ইসলামী গাডেরা সুনিপূণভাবে যুদ্ধ করে ইরাক বাহিনীর মোকাবেলা করেছিলো।
এখন আমেরিকা ইরানের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ স্থাপন করে রেখেছে। কারণ আমেরিকা ও ইসরায়েলের অভিযোগ ইরান আনবিক বোমা তৈরি করছে। অতীতে ইসরায়েল বহুবার ইরানের আনবিক স্থাপনার উপর আক্রমণ করার অভিলাষ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছিলো। ২০১৫ সালে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, বৃটেন ফ্রান্স অর্থাৎ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানি বসে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক নিরোধ চুক্তি সম্পাদন করেছিলো। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। এ চুক্তিটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সত্যায়িত করেছিলো।
মূলত এ চুক্তিটি বহুজাতিক চুক্তি আবার নিরাপত্তা পরিষদেরও অনুমোদন রয়েছে। সেই চুক্তিটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো ইরান পারমানবিক কার্যক্রম বন্ধ রাখবে এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু কমিশন ইরানের যে কোনও পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে পারবে।
ইরানের এ চুক্তি কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে একক চুক্তি নয়। কেউ এককভাবে এ চুক্তি বাতিলও করতে পারবে না। কিন্তু ট্রাম্প ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর চুক্তি বাতিল করতে চেয়েছিলেন কিন্তু জাতিসংঘ ও অন্য রাষ্ট্রগুলো এতে আপত্তি উত্থাপন করায় আমেরিকা চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এবং ইরান থেকে তেল না কেনার জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর উপর চাপ প্রদান করে আসছে।
২০১৮ সাল থেকে ট্রাম্প ইরানের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ খুব কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য ভূমিকা রেখে আসছেন। ইরানের অধ্যাত্মিক নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনিকে বলেছেন ইরান আনবিক বোমা বানাতে সক্ষম তবে ইরান তা বানাবে না। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন তারা প্রয়োজনে তাদের কার্যক্রম পুনরায় চালু করবেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ১৫ মে জানায়, দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের নির্দেশক্রমে পরমাণুশক্তি সংস্থার একজন কর্মকর্তা ইরানিয়ান স্টুডেন্টস নিউজ এজেন্সিকে (আইএসএনএ) বলেছেন যে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পরমাণু চুক্তির’ কিছু অংশ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালের ‘পরমাণু চুক্তি’ অনুযায়ী তেহরান কম-পরিশোধিত ইউরেনিয়াম ৩০০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন করতে পারবে। পাশাপাশি ভারী জল উৎপাদন করে মজুদ করতে পারবে ১৩০ টনের মতো। অতিরিক্ত পরিমাণ ইউরেনিয়াম ও ভারী জল উৎপাদন করা হলে ইরানকে তা হয় বিক্রি করতে হবে, নয়তো অন্যদেশে মজুদ করতে হবে।
ইরান বলছে, এখন থেকে ইউরেনিয়াম ও ভারী জল উৎপাদনের ক্ষেত্রে তারা কোনও বাধা মানবেন না। অবশ্য এই নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ইরান আপাতদৃষ্টিতে পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘন করছে না। কিন্তু, গত ৯ মে দেশটির রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত বক্তব্যে যে ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন তা যেনো ছয়দিনেই শেষ হয়ে গেলো। রুহানি সেসময় বলেছিলেন যে চুক্তির অপর অংশীদার জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং চীন আগামী ৬০ দিনের মধ্যে আলোচনার টেবিলে ফিরে না এলে এবং ইরানের খনিজ তেল বিক্রি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা দিতে না পারলে চুক্তির কিছু অংশ থেকে তার দেশ সরে আসবে।
কিন্তু, ইরানের এই সময়সীমা বেঁধে দেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জামার্নি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জানিয়েছিলেন, তারা এখনো চুক্তির প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরপর পরই আমেরিকা তার পক্ষে আনার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হুমকি অভিযোগ করে সে সম্পর্কে ইউরোপকে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রয়টার্স আরেক খবরে জানিয়েছে, ইরানে হামলার ছক নতুন করে সাজিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে ১ লাখ ২০ হাজার সেনা পাঠানোর কথা ভাবছে। ১৩ মে এই এসব তথ্য নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করেছে। ইরান অবশ্য বিষয়টিকে ‘মনস্তাত্ত্বিক লড়াই’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘মার খাওয়ার জন্যে ইরানের হাতের কাছে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।’
ইরানের নিয়মিত সৈন্য সিরিয়ায় অবস্থান করছে তারা ২০১১ সালেই আরব বসন্তের সময় বাশার সরকারকে রক্ষা করার জন্য সিরিয়ায় গিয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহরাও ইরান বাহিনীর সঙ্গে সিরিয়ায় যোগদান করে। ইরান এবং হিজবুল্লাহ্ ঘাঁটি গড়ে সিরিয়ায় অবস্থান নিয়ে আছে। ইসরায়েলের কাছে এটা মাথা ব্যাথার কারণ। হিজবুল্লাহ্ একমাত্র বাহিনী যারা ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কখনও হার মানেনি। সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় হামাস ও ইসরায়েলিদের সঙ্গে এক কঠিন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ছিলো আর যাদেরকে ইসরায়েল সন্ত্রাসী বাহিনী বলতো সে হামাসের সঙ্গেই মিশরের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে।
গত বছরের মে মাসে আমেরিকা ইসরায়েলের আহ্বানে তেল আবিব থেকে তার দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে এনেছে। আবার গত ২৬ মার্চ গোলান মাল ভূমিকে ইসরায়েলের ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এখন চেষ্টা করছে ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে ইসরায়েলের একটা চুক্তি সম্পাদন করানোর জন্য। এসব বিষয়ে ইরান ও হিজবুল্লাহকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে আমেরিকা পারস্য উপসাগরে তার বিমানবাহিনী রণতরী ‘আব্রাহাম লিংকন’ পাঠিয়েছে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন আমেরিকা ইরানের সঙ্গে কোনও যুদ্ধ চায় না। তবে তাদের কাছে তথ্য আছে ইরান আমেরিকার স্থাপনায় আক্রমণ চালাবে বা তাদের পক্ষ হয়ে হিজবুল্লাহ আক্রমণ করবে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, হিজবুল্লাহর আক্রমণকেও আমেরিকা ইরানের আক্রমণ বলে গণ্য করবে। যে কোনও হামলা প্রতিহত করতে আমেরিকা প্রস্তুত। আরও একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করার মতো। সিরিয়ায় মার্কিন সমর্থিত সিরীয় বাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি হচ্ছে ইদলিব। এ ঘাঁটি দখল করার চেষ্টা করছে বাশার সরকার।
পুতিন বলেছেন, এ ঘাঁটির দখল অভিযানে রাশিয়ানেরা বাশার বাহিনীর সঙ্গে নেই। সুতরাং আমেরিকা ধরে নিয়েছে যে রাশিয়ান বাহিনী যখন ইদলিব দখলে বাশার বাহিনীর সাতে নেই তখন নিশ্চয়ই ইরান আর হিজবুল্লাহ বাহিনী ইদলিব অভিযানে সিরিয়াকে সাহায্য করছে। সুতরাং ইরানকে চাপে রাখার জন্য পারস্য সাগরে রণতরী নিয়ে আমেরিকা উপস্থিত হয়েছে। আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমে তেল রফতানির জাহাজ হরমুজ প্রণালী হয়ে যাওয়া আসা করে এ প্রণালী ইরানের মালিকানাধীন, ইরান হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে।
অথচ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু চাচ্ছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে ইসরায়েলের একটা এক তরফা চুক্তি সম্পাদন করাতে যা ইরান, হিজবুল্লাহ আর হামাসের কারণে বিঘ্নিত হতে পারে তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রণতরি, সৈন্য ও কাতারের ঘাঁটিতে বিমান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে ইরানকে চাপে রাখছে আবার শর্ত দিয়েছে হিজবুল্লাহর আক্রমণকেও তারা ইরানের আক্রমণ বলে বিবেচনা করবে। ইরান বা মার্কিনী বাহিনী পরস্পরকে আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না কিন্তু হিজবুল্লাহ বা ইসরায়েল যদি অতি উৎসাহী হয়ে কোনও আক্রমণের সুযোগ তালাশ করে তবে মধ্যপ্রাচ্যে আবার দাবানল জ্বলে উঠবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম