পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারে ‘সরকারি কোম্পানি’
তানভীর আহমেদ
ভারতের পুঁজিবাজার বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল সেই দেশের সরকারি কোম্পানিগুলো। অথচ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানির কোনো ভূমিকাই চোখে পড়ে না। আমরা কথায় কথায় ভারতের পুঁজিবাজারের কথা বলি কিন্তু সেই দেশের কোনো ভালো উদ্যোগ আমরা নিতে পারি না। যদি নিতে পারতাম তাহলে ২০১০ সালের ধসের ৯ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও একের পর এক মিটিং করতে হতো না বাজার স্বাভাবিক করতে।
আজও দেশের মানুষ টাকা ব্যাংকে রাখতে গেলে সরকারি ব্যাংকগুলোকেই আস্থার জায়গা হিসেবে খুঁজে নেয়। তারা বিশ্বাস করে আর যাই হোক তাদের টাকা ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বা ফার্মারস ব্যাংকের মতো মার যাবে না। সরকার যেভাবেই হোক তাদের টাকার নিশ্চয়তা দেবে। আজও মানুষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করতে চাইলে সরকারি সঞ্চয়পত্রকেই সবচেয়ে এগিয়ে রাখে। অথচ অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানিগুলোর কোনো মূল্যায়ন নেই।
দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কথা ছিল সরকারি কোম্পানিগুলো। কারণ একটু দাম বাড়লেই এই কোম্পানিগুলোতে ডিরেক্টর সেল আসার কোনো সুযোগ নেই। সম্পদ বিক্রি বা ব্যাংক থেকে লোন করে ডিরেক্টর বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার মতো কোন ঘটনাও ঘটবে না। ইপিএস (EPS) বেশি দেখিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করছে এমন ভয়ের কিছু নেই সরকারি কোম্পানিগুলোতে। তারপরও সরকারি কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই।
২০১০ সালে বাজার যখন চাঙ্গা ছিল তখন ডেসকো, তিতাস, পাওয়ার গ্রিড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা ওয়েল, পদ্মা ওয়েলের মতো সরকারি শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ছিল সবার তুঙ্গে।
২০১০ সালে ডেসকো ৩৫০০ টাকা, তিতাস ১৪০০ টাকা, পাওয়ার গ্রিড ১২০০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। কিন্তু সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে সরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীরা এখন আস্থাহীনতায় ভুগছে। সরকারি ভুল সিদ্ধান্তের মধ্যে অন্যতম ছিল তিতাসের গ্যাস বিতরণ চার্জ কমিয়ে দেয়া। হঠাৎ ২০১৪ সালে বিতরণ চার্জ ৫৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ২৩ পয়সা করে সরকার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করেছে।
বর্তমান পুঁজিবাজারে ডিরেক্টর সেল, প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং দুর্বল কোম্পানির ভারে নুয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি লাভজনক বড় মূলধনী কোম্পানিগুলো যদি বাজারে তালিকাভুক্ত করা যেত তাহলে দেশি বড় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হতো। অনেক কালো টাকার মালিক তাদের টাকা বড় মূলধনী সরকারি কোম্পানিগুলোতে নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করতে পারতো। প্রচুর টাকা ঢুকত বাজারে। সরকারি কোম্পানিগুলো দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগকারীর কাছেই সব সময় আকর্ষণীয় হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকারি কোম্পানিগুলো সবসময় কিছু বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে সরকার থেকে। যেমন বেশির ভাগ সরকারি কোম্পানি একাধিপত্য (Monopoly) ব্যবসা করে। কোম্পানিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কোম্পানি নেই। যেমন- ডেসকো, পাওয়ার গ্রিড, তিতাস।
গত ৯ বছরে ৯২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে, যার বেশির ভাগই দুর্বল মৌলভিত্তিক কোম্পানি। অথচ গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে মাত্র একটি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২০১০ এর বাজার ধসের পর অনেক বার সরকারি কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত করার ঘোষণা এলেও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে আজ পর্যন্ত একটি কোম্পানিও বাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী কম করে হলেও ১০ বার সরকারি কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি কোম্পানিও তালিকাভুক্ত করতে পারেননি। গত মাসেও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. স্বপন কুমার বালা বলেছেন, চলতি বছরই কয়েকটি সরকারি কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসতে পারে।
প্রাইভেট কোম্পানিগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও সরকারি কোম্পানিগুলো সরকার চাইলেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। একমাত্র সরকারের সদিচ্ছাই পারে পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে। তালিকাভুক্ত সরকারি যে কোম্পানিগুলো রয়েছে সেই কোম্পানিগুলোর মুনাফা বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি নতুন করে সরকারি লাভজনক বড় মূলধনী কোম্পানিগুলো বাজারে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে সরকার সহজেই পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারবে। আর তখন কেউ চাইলেই চক্রান্ত করে বাজার ফেলে দিতে পারবে না। আশা করি মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ বাজারসংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।
এসএইচএস/পিআর