মা মানে এক আকাশ ভালোবাসা
মনদীপ ঘরাই
মা। একটা পুরো পৃথিবী আছে ক্ষুদ্রতম এই শব্দে। কারণ, মধুর এই শব্দের পেছনের মানুষটা। কে ভালোবাসে না মা কে? জগতের কারও উত্তর নেতিবাচক যে হবে না, তা চোখ বুজে বলে দেয়া যায়।
তবুও কি সুখে আছে জগতের সব মা? আপনার মা? কিংবা আমার মা?
মায়ের শাড়ি, মায়ের ওষুধ, মায়ের ফোনের রিচার্জ। সন্তান হিসেবে এগুলো নিশ্চিত করতে পারলেই সফল সন্তান বলে মনে হতে পারে নিজেকে। মা মানে তো দায়িত্ব। মা মানে তো কর্তব্য।
চলুন ফিরে যাই আমাদের শৈশবে। পড়াশোনার জন্য বকা বা একটু-আধটু মার পিঠে পড়েনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিনই হবে। সে বকা খেয়ে গাল ফুলিয়েছি মায়ের ওপর। মনে হয়েছে বাসা ছেড়ে চলেই যাই। দিন শেষে রাত নামলে যখন মাকে দেখতাম সেই বকার জন্য নিজেই কাঁদছে, আদর করে টেনে নিচ্ছে কোলে, তখন মনে হতো জগতে আর কি চাই?
ভাত খাওয়া শেষে ভেজা মুখটা মুছতাম মায়ের আঁচলে। তোয়ালে বা টিস্যু পেপার মন টানতো না একদম। মা ও যেন অপেক্ষা করেই থাকতেন, কখন খাওয়া শেষ হবে। মা চুল আঁচড়ে দিতো। যত্ন করে। পরিপাটি করে। এরপর বড় হয়ে হাজারটা স্টাইলে চুল "পারফেক্ট" করার চেষ্টা করেছি; পেরেছি কি?
জ্বর হলেই ভুল বকেছি। রান্না ফেলে পাশে বসে থাকা মাকে টেনে ধরে রেখেছি। যেতে দেই নি। কারণ, মা চলে গেলে তো জ্বরে মরেই যাবো। গৃহিনী মায়েদের হাতে তেমন টাকা থাকে না। আমার মায়ের হাতেও থাকতো না। তারপরেও অবুঝের মতো এটা-ওটা কেনার জন্য টাকা চাইতাম। পেয়েও যেতাম। পরে বুঝেছি, এই আবদারের জন্যই কষ্ট করে জমিয়ে রাখতো মা।
মায়ের হাতের রান্না তো পৃথিবীর সেরা। সবার কাছেই। তবুও সবজি রান্না কোনদিন ভালো লাগতো না। কারণ, সবজিই তো পছন্দ করতাম না। মা বুঝতো, কিন্তু জোর করে খাওয়াতো। কত যে রাগ হতো! এখন বুঝি কি প্রয়োজনে এই জোর করা।
মা মানেই তো সকালের খাবার রেডি, স্কুলের টিফিন রেডি, স্কুল থেকে ফিরে আগুন ক্ষুধায় দুপুরের খাবার রেডি। শীতকালে স্নানের গরম জল, গরমে শীতল পাটি। মা মানেই রাতের মশারি, গায়ের চাদর সবকিছু ঠিকঠাক থাকা। এমনকি ব্রাশে পেষ্টটা পর্যন্ত মাখা থাকতো হুট করে আলস্যে যদি ঘুমিয়ে পড়ি, সেই ভয়ে।
রেজাল্ট খারাপ? মা। বন্ধুদের সাথে ঝগড়া? মা। আর বলবোই বা কার কাছে?
সময় বদলে গেছে বয়সের সাথে। একসময় বলতাম, মা কে ছাড়া একদিনও দূরে থাকবো না। ক্লাস নাইনে যখন রেসিডেসিয়াল মডেল কলেজের হোস্টেলে গেলাম, সেবারই প্রথম পাকাপাকি ভাবে মায়ের থেকে দূরে। সে কান্না আর প্রতিদিন লেখা চিঠিগুলো এখনো চোখে জল আনে।
এরপর আর ফেরা হয়নি বাসায়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি। মা থাকতো আমার ছুটির অপেক্ষায়। আমিও। ফোনে শুধু একটাই প্রশ্ন কবে আসবি বাবা?
যতই ফেসবুকে আমরা সুখের সাগরে ভাসি না কেন, কেউ আসলে চিরসুখী নয়। মায়ের কষ্ট, মায়ের কান্নার সময়গুলোতে ছোটবেলা থেকেই সাথে থাকতাম। অল্প বয়সে আমার অনেক কিছু শেখা হয়েছে। মায়ের সাহস ছিলাম আমি।
আমার মা সব পারে। পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা, জানি মা সাহস দেবে। চাকরিতে প্রতিকূল পরিবেশ ; মা কে বলি আশীর্বাদ কোরো, মা গো। সেই সব পারা মা কে যেদিন দেখলাম হাসপাতালের বিছানায়,মেলাতে পারি নি হিসাব। মনে হলো চোরাবালিতে ডেবে যাচ্ছি, পুরোটা আমি। মাকে সুস্থ্ করে বাসায় এনেছি। তবুও ভয়, তবুও চিন্তা।
অবাক লাগে, যখন স্বাবলম্বী এই আমাকে মা জিজ্ঞেস করে,"বাবা, তোর টাকা আছে তো? নাকি দেব?"
সব মায়েদের রক্তের গ্রুপ হওয়া উচিত ছিল ও নেগেটিভ। যারা শুধু দিতেই জানে, নিতে জানে না।
আমার চাওয়া তো মায়ের নখদর্পণে। মায়ের চাওয়া কি? এখনও শৈশবের মতো অবুঝই রয়ে গেছি এই ভাবনাতেও। নিজের যা কিছু ভালো মনে হয়, চাপাতে চাই মায়ের ওপর। এই মা দিবসেই দেখুন না, চিন্তা করে রেখেছি কি দেব মা কে। শাড়ি, ফুল কিংবা নিত্য ব্যবহার্য কিছু! অথচ, মায়ের ওসব চাহিদা কখনও ছিলই না! হয়তো দেরিতে, তবুও এখন বুঝি। মায়ের একমাত্র চাহিদা, সন্তানের কাছ থেকে খানিকটা সময়। শুধু তার জন্য। একেবারে নিজের। ভালো মানুষ সাজতে চাই না। ব্যস্ততার মধ্যে "মা, পরে কল দিচ্ছি " বলে ফোন আমিও রাখি। " এইসব তুমি বুঝবে না" বলে অভিমান আমিও করি।
তাই, এবারের মা দিবসে মায়ের জন্য দিতে চাই সময়। খাওয়ার পর আবার মুখ মুছতে চাই মায়ের আঁচলে। লুকিয়ে ফেলে দিতে চাই অপছন্দের সবজি। আবদার করে নিতে চাই পঞ্চাশ টাকার একটা নোট।
বিশ্বাস করো মা, একটুও বড় হই নি। আছি ঠিক আগের মতোই। তোমার কোলে মাথা রেখেই যেন জীবনের বাকি ক'দিন কাটে।
মা মানে দায়িত্ব না। মা মানে কর্তব্যও না। মা মানে শুধুই ভালোবাসা। এক আকাশ ভালোবাসা।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
[email protected]
এইচআর/এমএস